লিয়াকত হোসেন খোকন
কিসের সংখ্যাগুরু, কিসের সংখ্যালঘু - সবাই আমরা বাংলাদেশী, সবাই আমরা বাঙালি। আমাদের দেশে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু বলে কিছু নাই।
চির মধুর বাংলাদেশে হাজার বছর ধরে সবাই মিলে বসবাস করছি এবং ভবিষ্যতেও করতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। তাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, এর কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি।
এদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, " এভাবে হিন্দুদের ওপর
নিপীড়ন -অত্যাচার চলতে থাকলে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে কয়েক বছরের মধ্যে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশকে ফের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করতে পারত। সংবিধান সংশোধন করতে পারত। তবে করেনি। সব জায়গায় হিন্দু বিদ্বেষী ও ধর্মান্ধদের বসবাস। আমাদের এখনও বিশ্বাস টিকে আছে একমাত্র শেখ হাসিনার ওপর। তিনি যদি কিছু করতে পারেন তবেই আমরা বাঁচব। "
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরই বাংলাদেশের নিজস্বতা নষ্ট হয়েছে। সামরিক শাসক জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি একে একে ধ্বংস করে দিয়ে পাকিস্তানি কায়দায় দেশ শাসন করতে শুরু করে। জেনারেল জিয়ার আশ্রয় প্রশ্রয়ে লালিত পালিত হয়ে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আবার জেগে ওঠে - ক্রমশ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ডালপালা এতটা বিস্তার লাভ করার কারণে বাংলাদেশে গত ৯ বছরে হিন্দুদের ওপর হাজারের উর্ধ্বে হামলা হয়েছে। প্রতিবছরই মন্দির ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর হামলা করছে মুষ্টিমেয় মুসলিম মৌলবাদীরা। ১৯৮৮ সালে
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম হওয়ার পর থেকে বারবার হামলার শিকার হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনার পর চর্চায় উঠে এসেছে দেশের হিন্দুদের জনসংখ্যা ও তার পতনের হার। ১৯৪৭ সালে দেশের জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল হিন্দু আর আজ সেখানে নেমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ শতাংশে।
আমাদের কথা, হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা কেন দেশ ছাড়বেন? এদেশে তাদের জন্ম, এদেশ তাদের মাতৃভূমি - যারা আক্রমণ করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। প্রতিরোধ গড়ার সময় এসেছে, এবার হিন্দুভাইদেরকে জাগতে হবে। হবেই জাগতে - জাগুন হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা, নজরুলের মতো বিদ্রোহী হয়ে উঠুন। এদেশ আপনাদের - কেন মাতৃভূমি ছেড়ে যাবেন। যারা ছেড়ে গেছে তাদেরকে প্রয়োজনে ফিরিয়ে আনুন। নিজেদের শক্তি দিয়ে রুখে দিন মুষ্টিমেয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে।
মনে রাখবেন, মুসলিম নামধারী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী বা মৌলবাদীর সংখ্যা সামান্যমাত্র। আর সাম্প্রদায়িক মুসলিম মৌলবাদী দেশের একশ্রেণির নরপশু - এরাই হল সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। এই নরপশু সাম্প্রদায়িকবাজদেরকে কোনো হামলার সঙ্গে জড়িত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিচার সম্পন্ন করা হলে দেশ থেকে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী চিরনির্মূল করাও সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে কঠোর হতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতার বীজবাষ্প চিরতরে রুখতে হলে
স্কুল -মাদ্রাসার পাঠ্যপুস্তকে সকল ধর্মের মনিষীদের জীবন কাহিনী ও তাঁদের জীবন দর্শন পড়ানো আবশ্যক। হযরত মুহাম্মদ সা, এর পাশাপাশি লালন ফকির, শ্রীকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ পরমহংস, যীশু এদেরকে জানার সুযোগ করে দিতে হবে স্কুল -মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তবেই সবার মধ্যে মনিষীদের জীবনাদর্শ হৃদয়ে ঠাঁই পাবে। অতঃপর আগামি দিনের সবাই হবে মানবিক, সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একটি মানবিক -সম্প্রীতির জীবন খুঁজে পাবে।
আজও আমরা শুনতে পাই, অধিকাংশ মাদ্রাসায় শহীদ মিনার নাই, সেই সকল মাদ্রাসায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও নাকি পরিবেশন করা হয় না। এ অবস্থা আর চলতে দেয়া যায় না। সকল মাদ্রাসায় যাতে শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়, জাতীয় সংগীত যাতে পরিবেশিত হয় - এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখনই দৃষ্টি দিতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় আরবীর পাশাপাশি চাই সাহিত্য, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ক্রিড়া, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক পাঠ্যসূচী। মাদ্রাসাগুলিকেও পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রীয়করণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তুলতে হবে। তাছাড়া বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় মাদ্রাসা স্থাপন করে কি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে - এ ব্যাপারে সরকারের নজরদারি চাই। মাদ্রাসাগুলিতে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সঠিক শিক্ষার আলো খুঁজে পাবে। তবেই তাদের মধ্যে আর ধর্মান্ধতা জাগ্রত হবে না।
আমাদের এ বাংলাদেশের হৃদয়ে মিলেমিশে আছে
হিন্দু সম্প্রদায়ের অবদান। তাঁদের অবদানে আজ আমরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত। আর সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি হল - জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ,
মুরারি চাঁদ কলেজ, মদন মোহন কলেজ, ব্রজলাল কলেজ, ব্রজমোহন কলেজ, রাজেন্দ্র কলেজ, সারদা সুন্দরী কলেজ, আনন্দ মোহন কলেজ, গুরুদয়াল কলেজ, বৃন্দাবন কলেজ, মাইকেল মধুসূদন কলেজ,
প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ, দেবেন্দ্র কলেজ, হরগঙ্গা কলেজ, কেশবচন্দ্র কলেজ, স্যার আশুতোষ কলেজ ইত্যাদি আরও কত কি।
হাজার বছর ধরে এই আমাদের বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মগ, চাকমা, সাঁওতাল বসবাস করে আসছি। বাংলাদেশে আলাদা করে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই। সবাইকে মনে করতে হবে, আমরা কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘু নই - আমরা সবাই বাংলাদেশের বাঙালি বা বাংলাদেশী।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কে হিন্দু, কে মুসলিম, সেটা বিচার করা লজ্জাজনক।
তা-ই তো, ব্যক্তিগতভাবে আমি নারায়ণগঞ্জ গিয়ে নারায়ণকে ; জয়দেবপুর গিয়ে জয়দেবকে ; কিশোরগঞ্জ গিয়ে কিশোর বাবুকে ; শ্রীহট্টে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে ; জৈন্তাপুর গিয়ে জয়ন্তীকে ; গোপালগঞ্জ গিয়ে গোপালকে ; লক্ষ্মীপুর গিয়ে লক্ষ্মী দেবীকে ; রামচন্দ্রপুর গিয়ে রামচন্দ্রকে ; ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে ব্রাহ্মণদেরকে ; জয়পুরহাট গিয়ে জয়পালকে আর বগুড়া গিয়ে পুণ্ড্রবর্ধনকে খুঁজে পাই।
তখন মনের আনন্দে গেয়ে উঠি, আমার এ বঙ্গভূমি হিন্দু, মুসলমান আর সকল সম্প্রদায়ের। আমরা সবাই রাজার রাজা আমাদের এই বাংলাদেশে। আমাদের সবার উৎসব দুর্গাপূজা, ঈদুল ফিতর, শ্যামাপূজা, বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, ঈদুল আজহা, মহররম, ঈদে মিলাদুন নবী, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা, শিবপূজা।