ADVT

বাঙালি জাতির উত্তরণে বিদ্যাসাগর

পাভেল আমান

রাজা রামমোহন রায়ের পর বাঙালির সমাজজীবনে, মননে, চিন্তনে সব থেকে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী মনীষীর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ টোলো পন্ডিতের ঘরের ছেলে হয়ে এবং তৎকালীন সমাজবাস্তবতায় আপাদমস্তক সংস্কৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তিনি উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ সমাজবিপ্লবীতে উন্নীত হয়েছিলেন। যা ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ঘটনা। ১৮২০ থেকে ১৮৯১—এই একাত্তর বছরের জীবদ্দশায় নিজের সর্বতোমুখী  প্রতিভা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের জোরে তিনি শিক্ষা প্রসার ও সমাজ সংস্কারে বৈপ্লবিক ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হয়েছিলেন। নারী শিক্ষার প্রসার, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা, আধুনিক পাশ্চাত্য জ্ঞান ও দর্শনে  ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত করার সাহসী প্রয়াস, বাংলা গদ্যসাহিত্যের গঠনশৈলীর উন্নয়নে প্রচেষ্টা, জাতিভেদ ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানসহ বাল্যবিবাহ-বিধবাবিবাহ-বহুবিবাহ রদে তাঁর অসাধারণ শাস্ত্র বিশ্লেষণ ও আইন প্রণয়নে সর্বস্ব পণ মৌলিক প্রচেষ্টাগুলি তৎকালীন সামাজিক অজ্ঞানতা, প্রতিকুলতা, অসহযোগিতার প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী কর্মকান্ড রূপেই অভিহিত হবার যোগ্য।তার কাছে মানুষই ছিল মুখ্য তাই মানুষের মুক্তির জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সাদা ধুতি,চাদর ও চটি পরিচিত এই তেজস্বী ব্রাহ্মণ এর মধ্যে নবজাগরণের প্রবল যুক্তিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার এক অপূর্ব প্রভাব ঘটেছিল। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে — এই ভীরুর দেশে তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ সিংহ। পৌরুষ' এবং 'আপসহীন মনুষ্যত্বে' তিনি একক বাঙালি সত্তা। অনেকে তাকে কেবল 'দয়ার সাগর', 'করুণার সাগর' বলে বাহবা দিয়েই তৃপ্তি লাভ করেন কিংবা দায় সারেন। বাঙালি সমাজকে, বাঙালি জীবনকে মুক্তির পথ দেখাতে বিদ্যাসাগরের প্রতিটি কর্মযজ্ঞ যে কতটা সুদূরপ্রসারী তা আমরা আজও অনুধাবন করতে পারি না। বাঙালি সমাজ ও বাঙালি সর্বস্তরের মানুষকে শিক্ষিত করার স্বপ্ন এবং প্রয়াস লালনকারী বাঙালিজনের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বিদ্যাসাগরকেই আমরা ব্যাপকভাবে পাই। বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন সংস্কৃত জ্ঞানভান্ডার ও ইংরেজি জ্ঞানভান্ডারের সম্মিলিত সম্পদে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের স্বদেশীয় ভাষাসমূহকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো- পাশ্চাত্য প্রভাবিত হয়েও বিদ্যাসাগর নিজস্ব সমাজ ও স্বদেশের কৃষ্টি-কালচারকেই মূলত বিকশিত করতে চেয়েছিলেন। আজকের এই মিথ্যার যুগে বিদ্যাসাগর কতটা প্রাসঙ্গিক? বর্ণপরিচয়ে তাঁর 'সদা সত্য কথা বলিবে' উপদেশ কি আজকের ছেলেমেয়েদের মনে দাগ কাটবে? তাঁর নীতির পাঠের থেকে হয়তো কেউ মুখ ফিরিয়ে নেবে। হিন্দুত্বের ধ্বজাধারীরা তাঁকে চিনবে না, তাঁর সাদা চাদর পরিহিত দীপ্ত আবক্ষ মূর্তি ধুলায় লুণ্ঠিত হওয়াই আজকের রীতি। অথচ বাংলার আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বিদ্যাসাগরকে স্মরণ করা আজ বিশেষ প্রয়োজন। বাংলার শিক্ষা ও সমাজের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র উন্মুক্ত ও উদার মননের প্রতীক। তাঁর বিদ্যা ও দয়া, কোনওটাই ভুলবার নয়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বক্তৃতা শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগরের চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণের কথা বলে— "যে গুণে তিনি পল্লী-আচারের ক্ষুদ্রতা, বাঙালীজীবনের জড়ত্ব সবলে ভেদ করিয়া একমাত্র নিজের গতিবেগপ্রাবল্যে কঠিন প্রতিকূলতার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া— হিন্দুত্বের দিকে নহে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে নহে— করুণার অশ্রুজলপূর্ণ উন্মুক্ত অপার মনুষ্যত্বের অভিমুখে আপনার দৃঢ়নিষ্ঠ একাগ্র একক জীবনকে প্রবাহিত করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন।" বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবর্ষে যদি আমরা উগ্র হিন্দুত্ব ও সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করে বাঙালি জীবনকে আবার অপার মনুষ্যত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারি, তবে সেটাই হবে এই অনন্য ব্যক্তিত্বের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা অর্পণ।তিনি সমাজ সংস্কারক, মানবদরদী, শিক্ষার আলোকবর্তিকা, গদ্যকার ও বাংলা লিপির সার্থক রূপকার। তিনি এই বাংলা এবং বাঙালির জন্য তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তার হৃদয়টা কুসুম-কোমল। মানুষের জন্য নিবেদিত। তার মতো অসাধারণ ও বিরল মেধাদীপ্ত প্রবাদ-প্রতিম মানুষ এই পৃথিবীতে খুব কমই জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম দিবসে শুধুমাত্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বড় বড় গাল ভরা কথা তার আদর্শ নিয়ে চর্চা করলেই আমাদের বাঙালি হিসেবে দায়িত্ব পালন হয় না যতক্ষণ না ব্যবহারিক জীবনে আমরা তার জীবন দর্শন প্রয়োগ না ঘটাতে পারছি। দ্বিশতবর্ষ পেরিয়েও এখনো তিনি বাঙালি জনমানসে চরমভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি বিদ্যাসাগরের দেখানো পথে এগিয়ে যেতে পারি তাহলে চেতনায় জাগরণে মননে নিঃসন্দেহে বাঙ্গালীরা বিদ্যা বুদ্ধি উৎকর্ষতাই এগিয়ে যাবে। যত বিভেদ বৈষম্য ধর্মীয় সংকীর্ণতা জড়তা হীনমান্যতা সবকিছু পিছনে ফেলে আপামর বাঙ্গালীদের বিদ্যাসাগরকে মন প্রানে গ্রহণ করে প্রাত্যহিক জীবনে স্মরণ করে বাঙালি জাতিসত্তাকে জাগ্রত করতে হবে সেখানেই বাঙ্গালীদের উত্তরণ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(02)

আলোচনা করুন, আলোচনায় থাকুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার আলোচনা তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !