বটুকৃষ্ণ হালদার
অযোধ্যায় রাম মন্দির নাকি বাবরি মসজিদ এ বিতর্কের শেষ কোথায়?কেউ বা বলছে মন্দির আর কেউ বা মসজিদ।কিন্তু সঠিক কোনটা তা জানতে রাম মন্দিরের প্রকৃত ইতিহাস জানা খুব দরকার। ইদানিং এক মুসলিম ধর্মগুরু রাম মন্দির ভেঙে ফের গড়া হবে মসজিদ এই বলে হুংকার দিয়েছেন, তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শুধু একজন মুসলিম ধর্মগুরু নয় তথাকথিত মুসলিম সমাজের একাংশ নির্বোধরা ও রাম মন্দির ভেঙে ফেলার সমর্থনে পা বাড়িয়ে আছেন।তবে একটি রাষ্ট্রের কাছে ধর্ম খুব স্পর্শকাতর বিষয়।প্রকৃত ইতিহাস না জেনে মূর্খের মতো হুংকার দেওয়া সম্পূর্ণ আইন বিরোধী,এটা কিন্তু জানা খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ দেশের আইন ব্যবস্থা এখনো মরে যায়নি।তাই যে কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করতে গেলে আইনের পথে করাটা একজন সচেতন নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব,কর্তব্য হওয়া উচিত।এক্ষেত্রে আরো জেনে রাখা ভালো যে,আমাদের দেশের বহু রাজ্যের রাস্তা কিংবা রেললাইনের ধারে সরকারী জায়গা দখল করে অনেকেই ঝুপড়ি বেঁধে বসবাস করছে, তাও আবার কর পরিষেবা ফাঁকি দিয়ে, আর এক শ্রেনির জনগণ মুখে রক্ত তুলে পরিশ্রম করে সরকারকে কর পরিষেবা দিয়ে চলেছে তাদের লালন পালনের জন্য, ভোট ব্যাংকের স্বার্থেই কিছু স্বার্থপর রাজনৈতিক দলগুলো ঝুপড়ি বাসীদের লালন পালন করে চলেছে। আর দ্বিগুণ হারে কর পরিষেবার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর উপর,তাদের উচ্ছেদ করতে গেলেই এক শ্রেণীর খেপাটে হায়েনার দল হই হই করে ছুটে আসেন। তাদের উচ্ছেদ করার সময় অনেকটাই বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হয়। তাই রাম মন্দির রাস্তা কিংবা রেল লাইনের ধারে কোন ঝুপড়ি নয় যাকে যখন খুশি তখন তুলে ফেলা যায়।রাম মন্দির হলো জাত,ধর্ম( অনেক মুসলিম ধর্মের জনগণ রামকে ভালোবাসেন সে প্রমাণ আমরা বহুবার পেয়েছি)রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে ধর্মীয় আবেগ সে কথা স্বীকারকরেছেন কংগ্রেসের বহু নেতা মন্ত্রীরা। তাই ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করতে গেলে হয়তো অনেকটা রক্তপাত হতে পারে।হিন্দুরা অবশ্যই রাম মন্দির সম্পর্কে সচেতন, তাই যারা রাম মন্দির ভাঙ্গার চিন্তাভাবনা করছে তাদের হিন্দুদের সাথে মহা সংগ্রামের অবতীর্ণ হতে হবে সে বিষয়টা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে।কারণ রাম মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হিন্দুদের অস্তিত্ব।
রাম মন্দির নির্মিত হয় একাদশ শতাব্দীতে অর্থাৎ ১ হাজার থেকে১১শ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতানুসারে।১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে ইবরাহিম লোদীকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর, দিল্লিদখল করে। এরপর মুসলমান শাসকদের যে চিরাচরিত প্রথা, ক্ষমতা দখল করেই ইসলামের ঝাণ্ডা উড়ানো এবংঅমুসলিমদের উপাসনা ভেঙ্গে গুড়িয়েদিয়ে মসজিদ বানানো বা তাকে মসজিদে রূপান্তরিত করা, বাবর সেদিকে নজর দেয়। এজন্য বাবরের নির্দেশে তার সেনাপতি মীর বাকি খাঁ, ১৫২৭/২৮ সালে অযোধ্যা আক্রমন করে প্রথমে কিছু হিন্দুকে হত্যা করে এবং বাকিদেরবন্দী করে। এরপর ভারতের প্রধানরাম মন্দির,যা রামের জন্মভূমি অযোধ্যাতেই অবস্থিত, সেটার উপরেরঅংশ ভেঙ্গে ফেলে এবং মন্দিরের মূল ভিত্তির উপরেই মসজিদ তৈরি করে,যেটা বাবরি মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদ তৈরি করার সময়, যেসব হিন্দুদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিলো,তাদের গলা কেটে প্রথমে একটি পাত্রেসেই রক্ত সংগ্রহ করা হয় এবং তারপরজলের পরিরর্তে চুন-সুড়কির সাথে সেই রক্ত মিশিয়ে মন্দিরের মূল ভিতেরউপরই ইটের পর ইট গেঁথে মসজিদ নির্মান করা হয়। তাই ইসলামি প্রথাসম্মত মসজিদ এটা নয়, ইসলামের বিজয় অভিযানে হিন্দুদের মনোবল ভাঙতে যত্রতত্র অসংখ্য মন্দির ভেঙ্গে যেমন বিজয় স্মারক নির্মিত হয়েছিলো, বাবরি মসজিদও তেমনি বাবরের একটা বিজয় স্মারক।একইভাবে বাবর সম্বল ও চান্দেরীর মন্দির ভেঙ্গে তাকে মসজিদে রূপান্তরিত করে এবং গোয়ালিয়রেরনিকটবর্তী জৈন মন্দির ও বিগ্রহধ্বংস করে।বাবর যে রাম মন্দির ভেঙ্গে মসজিদবানিয়েছে, এর ঐতিহাসিক প্রমান হলো,বাবরের আমলেই হিন্দুরা ২১ বার লড়াই করেছিলো মন্দির উদ্ধারের জন্য।বাবর যদি মন্দির না ভেঙ্গে পৃথক একটি জায়গায় মসজিদ নির্মানকরতো, তাহলে কি হিন্দুরা সম্রাট নির্মিত মসজিদকে ভেঙ্গে দিয়ে সেখানে মন্দির স্থাপন করার জন্য ২১ বার লড়াই করার মতো দুঃসাহস দেখাতো ?আর এরকম দুঃসাহস দেখালে বাবর কি হিন্দুদের অস্তিত্ব তার সাম্রাজ্যে রাখতো ? এরপর হুমায়ূনেররাজত্বকালে ১০ বার এবং আকবরের রাজত্বকালে ২০ বার হিন্দুরা রামজন্মভূমিতে মন্দির উদ্ধারের জন্য লড়াই করে। শেষে আকবর একটি আপোষ নিষ্পত্তি করে মসজিদের পাশেই রাম মন্দির নির্মানের অনুমতি দেয় এবং ছোট একটি মন্দির নির্মিত
হয়। এসব উল্লেখ আছে, আকবরের শাসন কালের ইতিহাস "দেওয়ান-ই-আকবরি" তে। ওখানে মন্দির যদি না থাকতো তাহলে, হিন্দুরা এতবার লড়াইকেনো করলো, কেনো এইসব লড়াই এর ইতিহাস মুঘল ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হলো আর কেনোই বা আকবর একটি আপোষমীমাংসা করে মন্দির নির্মানে অনুমতি দিলো ?
আকবর মন্দির নির্মানে অনুমতি দেওয়ায় এবং মসজিদের পাশে একটি মন্দির নির্মিত হওয়ায়জাহাঙ্গীর এবং শাজাহানের আমলে এ নিয়ে কোনো লড়াই সংগ্রাম হয় নি।কিন্তু ঔরঙ্গজেবের সেটা সহ্য হলো না। সে একটি বাহিনী পাঠায় ঐ মন্দির ধ্বংস করার জন্য। ১০ হাজার লোকনিয়ে বৈষ্ণব দাস মহারাজ নামে এক সাধু, ঔরঙ্গজেবের এই বাহিনীকে প্রতিরোধ করে, ফলে সেবার মন্দির রক্ষা পায়। এরপর আরো কয়েক বার ঔরঙ্গজেব মন্দির ধ্বংসের জন্য তার বাহিনী পাঠায়, কিন্তু প্রতিবারই হিন্দুএবং শিখগুরু গোবিন্দ সিংহের নেতৃত্বেশিখরা মিলে মন্দিরকে রক্ষা করে বা দখলকৃত মন্দিরকে আবার উদ্ধার করে। কিন্তু ঔরঙ্গজেব দমবার পাত্র ছিলো না। মুঘল সৈন্যরা এক রমজান মাসের সপ্তম দিনে হঠাৎ আক্রমন করেআকবরের সময়ে মসজিদের পাশে নির্মিত হওয়া ঐ রাম মন্দিরকে ভেঙ্গে ফেলে এবং হিন্দুরা বাধা দিতে এলে প্রায় ১০ হাজার হিন্দুকে হত্যা করে।মুঘলদের আরেক ইতিহাসের বই আলমগীর নামায় এই ঘটনার উল্লেখআছে।এরপর ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় হনুমান গড়ির মোহন্ত উদ্ভব দাস,অস্ত্র হাতে নিয়ে রামজন্মভূমিকেউদ্ধারের চেষ্টা করেন। সেই সময় অযোধ্যার নবাব ফরমান আলীর মুসলিম সৈন্যদের সাথে হিন্দুদের যুদ্ধ
হয়। শেষে নবাব একটি ফরমান জারি ক'রে একটি প্রাচীর ঘেরা জায়গায় মন্দির নির্মান ও পূজা উপাসনার অনুমতি দিয়ে যুদ্ধের অবসান ঘটায় এবং হিন্দু ও মুসলমান সৈন্যরা মিলিতভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নেয়। মূলত নবাব এই আপোষ করতে বাধ্য হয়েছিলো সিপাহী বিদ্রোহে হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যের একত্রিত করার স্বার্থে।কিন্তুসিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে এইসব কিছুই জলে যায়। ইংরেজরা ঐ রাম জন্মভূমিরই একটি তেঁতুল গাছে অনেককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারে এবং নবাবের ফরমান ইংরেজরা বাতিল করেদেয়; ফলে আবারও হিন্দুরা ঐ স্থানেপূজা-প্রার্থনার অধিকার হারায়। শুধুতাই নয়, ইংরেজরা ঐ তেঁতুল গাছটিকেও সমূলে উপড়ে ফেলে।এরপর ১৯১২ সালে হিন্দুরা নির্মোহীআখড়ার সন্ন্যাসীদের নেতৃত্বে বহু প্রাণের বিনিময়ে জন্মভূমির একাংশ উদ্ধার করে এবং বাকি অংশ উদ্ধারের জন্য লড়াই হয় ১৯৩৪ সালে। এরপরই ইংরেজরা অযোধ্যার ঐ স্থানে হিন্দু মুসলমান সবার প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই থেকেই বাবরি মসজিদে কেউনামাজ পড়ে নি। ফৈজাবাদ কালেক্টরির রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে এসব ইতিহাস।ভাঙার সময় বাবরি মসজিদ ছিলো যে একটি পরিত্যক্ত মসজিদ, তা জঙ্গলও গাছপালায় ভরা এবং ক্ষয়ে যাওয়া মসজিদের দেয়ালের ছবি দেখে তা সহজেই বোঝা যায়।
১৫২৭ সাল থেকে হিন্দুরা রাম মন্দির উদ্ধারের জন্য লড়াই করেছে বা চেষ্টা করেছে, ছোট বড় মিলিয়ে মোটামুটি ৭৬ বার। ৭৭ তম বারের প্রচেষ্টায় ১৯৯২ সালে, বিজেপির নেতৃত্বেহিন্দুরা- দখল, রূপান্তর ও অসহিষ্ণুতার প্রতীক বাবরি মসজিদকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়। কিন্তু এই শেষ বারের প্রচেষ্টাও ছিলো প্রায় সোয়া ২বছরের। বিজেপির সমর্থনে হিন্দুরা প্রথম ২০ সেপ্টম্বর,১৯৯০ সালে জনসংকল্প দিবস পালন করে। এরপর বহু জেল জরিমানা হুমকি ধামকিকে অগ্রাহ্য করে কিছু প্রাণের বিনিময়ে ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে ভেঙে ফেলে বাবরি মসজিদ। তাই এই ৬ ডিসেম্বর দিনকে হিন্দু ধর্মের শৌর্যবীর্যের প্রতীক হিসাবে মানতা দেওয়া হয়।
যারা এ যাবৎ ভারতবর্ষের বুকে দাঁড়িয়ে বাবরি মসজিদ নিয়ে ভেঙে ফেলার ঘটনা নিয়ে মিথ্যা নাটক করে, মুসলিম ভোট টানার জন্য রাজনীতির ইস্যু বানায় তাদের বহু তথ্য প্রমান সহ এমন ইতিহাস মন দিয়ে পড়া উচিত। সেই সঙ্গে ভাবনার বিষয় হলো,তারা কোনদিন প্রশ্নটুকুও তোলেনি, এই অত্যাচারী ও বর্বর জাতিগুলো শিল্পী ও সৌন্দর্যপীপাসু হল কি করে? কবে থেকে ? ভারতের মাটিতে পৌছেই তারা হঠাৎ আর্কিটেক্ট হয়ে উঠেছিল, এটা ভারতের মাটির গুনে? নাকি ঐতিহাসিকদের দাবার চাল সাজানোর গুনে ? একবারও কি ভারতের মানুষের মনে হয়নি, এরা এদেশে লুঠ করতে এসেছিল নাকি শিল্পসৃষ্টি করতে ? কি দরকার ছিল কুতুবউদ্দিন আইবক এর এদেশে কুতুব মিনার বানাবার ?
তবে মনে রাখবেন,ভারতবর্ষে হিন্দুর ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার এই খেলা অনেক পুরোনো । বিগত ৮৫০ বছর ধরেই হিন্দুদের ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে । স্বাধীনতার পর বামপন্থী ও কংগ্রেসীরা একে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রয়োগের কথা ভেবেছে ।এর নাম দিয়েছে 'বৈজ্ঞানিক মার্ক্সবাদ'। ভারতের ইতিহাস থেকে বেছে বেছে বাদ দেওয়া হয়েছে রাজা অনঙ্গ সিং, রাজা জয় সিং, পাঞ্চাল রাজ আদিত্য মোহন, চোল রাজ রাঘবেন্দ্র চোল, রাজা পরমার্থীব দেব, রাজা বিজয় সিং, রাজা সর্বথাসিদ্ধ কৌশল, রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, রাজা অজাতশত্রু, রাজা সূসীমান গৌড় প্রভৃতিদের ।আর তাদের সৃষ্টিশীলতা ও শিল্পসূষমাকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তুঘলক, ঘোরী, আইবক, শক, হুন, পাঠান, মোগল কিংবা কুষানদের মতন বেদুইনের মাঝে । যাদের কাছে অত্যাচার, মাথাকাটা, গলাকাটাটাই ছিল একমাত্র শিল্প।
এক্ষেত্রে বেছে বেছে শুধু হিন্দুদের ইতিহাসকে লুকিয়ে দেওয়া হয়েছে । তবে কিছু সেকুলারবাদ মানুষজন রাজনীতির স্বার্থে যখন হিন্দুদের প্রাচীন শিল্প কলা গুলোকে বেছে বেছে মুসলিমদের মাঝে ভাগ বাটোরা করে দিচ্ছেন,তার মাঝে চুন শুড়কি খসে পড়ে প্রকৃত ইতিহাস সামনে আসছে। আগামী ভবিষ্যতে এমন বহু মিথ্যা শিল্প কলা গুলোর প্রকৃত ইতিহাস সূর্যের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে।