Select language to read news in your own language


Like SatSakal Facebook Page to stay updated.

আধুনিক বাংলা কবিতা কী পাঠকহীন হয়ে যাবে?

তুষার ভট্টাচার্য

সাম্প্রতিককালে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কয়েকটি বাণিজ্যিক পত্রিকা কবিতা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে l সম্ভবত এর মূল কারণ হল বাংলা কবিতার পাঠক সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান l তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলা কবিতা কী পাঠকহীন হয়ে যাবে ?
এখন প্রশ্ন উঠবে বছরভর হাজার হাজার  কবিতা তো প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রায় নিয়মিত অনিয়মিত ১৬০০ লিটল ম্যাগাজিনে ( তথ্যসূত্র : বাংলা সাহিত্যের ইয়ার বুক - জাহিরুল হাসান সম্পাদিত ) এবং অনলাইন মাধ্যমের প্রায় দুশো পত্রিকায় l  এই সব পত্রিকার অন্দর মহলে একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে এখানে যাঁরা কবিতা লেখেন তাঁরা নিজের কবিতাটি দেখে আর অন্য কোনও কবির কবিতা পড়তে কোনও উৎসাহ বোধ করেন না l কবিরাই যদি কবিতা পাঠ বিমুখ হন তাহলে পাঠকদের দোষ দিয়ে আর লাভ কী ?
যদিও  একথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে কোনও কালেই বাংলা কবিতার খুববেশি পাঠক ছিল না l এখনও নেই l
তাহলে এত চিন্তা কিসের ?
চিন্তা অবশ্যই আছে l  ইদানীং বাংলা সাহিত্যের মূল তিনটি ধারা - কথা সাহিত্য ( গল্প, উপন্যাস ,প্রবন্ধ ইত্যাদি  ), কাব্য সাহিত্য এবং নাট্য সাহিত্যের মধ্যে সবচেয়ে উপেক্ষিত  কাব্য সাহিত্য l একথা ভুললে চলবে না যে প্রাচীন কালে মানুষের মুখের কথ্য ভাষা এবং লেখার ভাষা ছিল পদ্যের মাধ্যমে l সেই প্রাচীন সাহিত্য ধারার প্রেক্ষাপট ভেবে  সাম্প্রতিক সময়ে
অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় হল  ঘরে বাইরে কাব্য সাহিত্য সম্পূর্ণ ব্রাত্য হয়ে যাচ্ছে l আশঙ্কা হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের এই অন্যতম ধারাটি অচিরেই না শুকিয়ে যায় !
       

                    (  ২ )

কেন বৃহত্তর সাহিত্য ক্ষেত্রে  ক্রমশ কবিতা  ব্রাত্য হয়ে পড়ছে ? এই বিষয়ে
একটি প্রসঙ্গ মনে পড়ছে l   একদা বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকায় কবি বিষ্ণু দে'র একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল l   কবি সৌজন্য সংখ্যা নিতে গিয়েছিলেন  - কবিতা ভবনে l সেই সময়ে বুদ্ধদেব জায়া সাহিত্যিক প্রতিভা বসু কবি বিষ্ণু দে'কে  জিজ্ঞেস করেছিলেন - তাঁর ( বিষ্ণু দে 'র ) প্রকাশিত কবিতাটির অর্থ বা মানে কী একটু বোঝাতে l বিষ্ণু দে বিপাকে পড়ে তাড়াতাড়ি কাজ আছে বলে কবিতা ভবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন l
এই প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজনের কারণ হল যে -  কবিতাটি এত দুর্বোধ্য ছিল যে কবি নিজেও তার অর্থ করতে পারেন নি l অথচ কবি বিষ্ণু দে'র
পাণ্ডিত্য ও বৈদগ্ধ নিয়ে কেউই প্রশ্ন তুলতে পারবেন না l
ষাটের দশকে প্রকাশিত রবীন্দ্র ঘরানার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা তরুণ কবিদের মুখপত্র   'কৃত্তিবাস' পত্রিকা পড়ে জনৈক বৃদ্ধা পাঠিকা  বলেছিলেন  - আধুনিক কবিতা পড়লে নাকি তার দাঁত ভেঙে যায় l এই কথা কৃত্তিবাস পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল l

বস্তুত ,বাংলা কবিতার সেই  অপরিসীম দুর্বোধ্যতা এখনও রয়ে গেছে l  কবিতার পাঠক সম্ভবত এই অর্থহীন  দুর্বোধ্যতার  কারণেই বাংলা কবিতা থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গিয়েছেন l তাই এখন কবিতার বই একশো কপিও বিক্রি হয়না lমুদ্রিত নামী লিটল ম্যাগাজিন দুশো কপি বিক্রি হওয়াটাই বিশাল ব্যাপার বলে মনে করেন লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক মশাইরা l
প্রসঙ্গত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ডঃ অশোক মিত্র ছিলেন বাংলা কবিতার একজন নিমগ্ন পাঠকl তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে আশির দশক থেকে তিনি আর বাংলা  কবিতা পাঠ করেন নাl তার কারণ হল  আধুনিক  কবিতার কোনও  অর্থ বা   মানে তিনি বুঝতে পারেন না বলে l
একথা স্বীকার করতেই হবে যে প্রয়াত অশোক বাবুর মতন এমন কবিতাপ্রেমী  বোদ্ধা বাংলা ভাষায় খুব কমই ছিলেন বা রয়েছেন l
 কবিতার অর্থই যদি কেউ অনুধাবন করতে পারেন তাহলে সময় নষ্ট করে আধুনিক, উত্তর আধুনিক বাংলা কবিতা কেন পড়বেন পাঠকরা ? এই সময়ের 
একজন কবি যখন লেখেন - 'মাথার খুলির উপরে বসানো রয়েছে মৃতের সাদা চোখ l ' তখন কবিতার নিমগ্ন পাঠক বলতেই পারেন যে এমনতর কবিতার লাইন যে কবি লিখেছেন  তিনি কী আদৌ  এই লাইনের কোনও অর্থ বলতে পারবেন ?  রোমান্টিক কল্পনা বা ফ্যান্ন্সি ইমাজিনেশনেরও তো একটা সীমারেখা থাকা দরকার l 
বাংলা কবিতার কোনও নিমগ্ন পাঠক তো প্রশ্ন তুলতেই পারেন  - মৃতের মাথার উপরে কখনও সাদা চোখ বসানো থাকতে পারে? 
শুধু দুর্বোধ্য শব্দ প্রয়োগ করে কবিতার শরীর নির্মাণ করলে সেগুলি কী আদৌ কবিতা হয় ? পোস্ট মর্ডান কবিদের একথা ভাবতে হবে যে তাদের কবিতায়  চিত্রকল্প ,রূপকের আড়াল  শব্দের মায়াজাল অবশ্যই থাকবে কিন্তু ভারি ভারি শব্দ প্রয়োগ ,এবং অর্থহীনভাবে কবিতা লিখে তারা কী  কী বাংলা কবিতার কোনও উপকার আদৌ করছেন ?

রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি লেখক কবিদের লেখা প্রসঙ্গে একদা বলেছিলেন - লেখক কবিদের লেখা হল সমকালের দর্পণ l  তাঁর সময়ের আর্থ সামাজিক চালচিত্র লেখায় না ফুটে উঠলে সে কোনও লেখক বা কবিই নয় l
রূপসী বাংলার নির্জনতা বিলাসী কবি তো কবেই বলেছিলেন - সবাই কবি নয় ,কেউ কেউ কবি l আর শক্তি চ্যাটুজ্জে   এত কবি কেন বলে অনিবার্য প্রশ্ন তুলেছিলেন l 
ইদানীং ঘাড়ে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে যে সব কবি , কবি সম্মেলনের মঞ্চ আলোকিত করেন , লবি বাজি, পিঠচুলকিয়ে , টাকা দিয়ে পুরস্কার লাভ করেন তাদের অধিকাংশই  না মানে বুঝে  বছরে হাজার হাজার কবিতা  লেখেন , টাকা দিয়ে পাঁচ দশটা কবিতার বই ছাপান   স্রেফ নাম প্রচারের জন্য l এমনতর কবির সংখ্যাই এখন বাংলা ভাষায় বেশি l বাংলা কবিতার জগৎ থেকে এই বেনোজল রোধ করবে কে ?

 বস্তুত ,  বাংলা ভাষার বৃহত্তর কবিতা পাঠককে আকর্ষণ করতে হলে কবিতা নির্মাণ হতে হবে সহজ সরল l সহজ অথচ সুন্দর কবিতা কেমন হতে পারে সেটা  সুভাষ মুখুর্জী ,নীরেন্দ্রনাথ ,সুনীল পড়লেই অনুভব করা যায় খুব সহজেই l ব্রাজিল ,আর্জেন্টিনার নান্দনিক ফুটবল সবার এত ভাল লাগে কেন ? খুব সহজ ভাবে জটলা না করে ছবির মতন পরিষ্কার  খেলে বলেই সবার ভাল লাগে l
যে কোনও শিল্পই তাই l বাংলা কবিতাকেও পাঠক প্রিয় করতে হলে সহজ সরলভাবে উপস্থাপন করা জরুরি বলে মনে হয় l


                      (৩)

ইদানীং দেখা যাচ্ছে এই উত্তর আধুনিক সময়ে ফেস বুক নামক সামাজিক মাধ্যমে আট থেকে আশি বছরের অনেক কবি দিন রাতে দিস্তা দিস্তা কবিতা  লিখে পোস্ট করছেন l  সেই সব কবিতা পরিচিত মহল লাইক করছেন ,কমেন্ট বক্স - বাহ, অসাধারণ ,সুপার্ব, খুব সুন্দর প্রভৃতি শব্দবানে ভরে যাচ্ছে ,এই দেখে কবির বত্রিশ ইঞ্চি বুক মুহূর্তে  ছাপ্পান্ন ইঞ্চিতে পরিণত  হয়ে যাচ্ছে l কিন্তু সেই কবি আদৌ ভাবছেন না যাঁরা লাইক করছেন তাঁরা হয়তো  কবিতা না পড়েই  তাঁর চেনা মুখ বলে আঙুল ছুঁইয়ে লাইক করছেন বা কমেন্ট করছেন l
এছাড়াও ফেস বুকে যাঁরা কবিতা পোস্ট করছেন ( অধিকাংশই দুর্বোধ্য এবং অর্থহীন শব্দের মারপ্যাঁচ ) সেটা আদৌ কবিতা পদবাচ্য হল কিনা সেটা তো পরীক্ষিত হচ্ছে না l আবার এটাও ভেবে দেখতে হবে যে ফেস বুকের কবিতা ক'জন  প্রকৃত পাঠক মন দিয়ে পড়েন ?
অতএব যে  যেমাধ্যমেই কবিতা লিখুন না কেন বাংলা কবিতা দুর্বোধ্যতার রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত না হলে অচিরেই পাঠকহীন হয়ে অন্তর্জলি যাত্রার দিকে এগিয়ে যাবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় l
প্রবন্ধ :
তুষার ভট্টাচার্য l
বহরমপুর l মুর্শিদাবাদ l
০৮/১২/২০২১l


ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon