Select language to read news in your own language


Like SatSakal Facebook Page to stay updated.

ছাত্র রবীন্দ্রনাথের স্কুলবেলা


তুষার ভট্টাচাৰ্য 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অভিভাবককুলের নিরন্তর শাসন, লেখাপড়ার জন্য চাপ প্রভৃতির কারণে শৈশবে রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছিলেন  অনাবিল মুক্তির আনন্দ, তাইরে নাইরে করে ঘুরে বেড়ানোর l কিন্তু তিনি তা কখনও পাননি l তাই তাঁর শৈশবের দিনগুলি  খুব বেশি আনন্দময় ছিল না l
বস্তুত, বালক রবীন্দ্রনাথের ইস্কুলের প্রথাগত শিক্ষা কোনোদিনই ভাল লাগে নি l এই কারণে তাঁর  বাল্যকালে অনেকবার ইস্কুল পাল্টানোর ঘটনা ঘটেছে l যদিও বালক রবির কোথাও মন টিঁকেনি l
এই প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ছেলেবেলা'  প্রবন্ধ গ্রন্থের শুরুতেই ' বালক 'কবিতায় লিখেছেন  -
কিশোরী চ্যাটুজ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে
বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে
দ্রুতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,
থাকতো আমার খাতা লেখা পড়ে থাকতো পড়া ;
পরিণত বয়েসে, বিদ্যালয়কে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে হাসপাতাল আবার কখনও জেলখানা l সেই কারণে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের মোট চারবার ইস্কুল পাল্টাতে হয়েছে l বারবার ইস্কুল পাল্টানো প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গভীর আক্ষেপ করে লিখেছেন  - যে বিদ্যালয় চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাসপাতাল জাতীয় একটি নির্মম বিভীষিকা তাহার নিত্য আবর্তিত ঘানির সঙ্গে কোনোমতেই আপনাকে জুড়িতে পারিলাম না l যখন আমার বয়েস তেরো, তখন এডুকেশন বিভাগীয় দাঁড়ের শিকল ছিন্ন  করে বেরিয়ে পড়েছিলাম l

প্রসঙ্গত, ছাত্র রবীন্দ্রনাথের প্রথম লেখাপড়া শুরু হয় কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে l এই স্কুল প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন  - পড়া বলিতে না পারিলে বেঞ্চে দাঁড় করাইয়া তাহার দুই প্রসারিত হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একত্র করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইত l
ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল ভাল না লাগায়, বাড়ির কড়া অভিভাবকরা, বালক রবীন্দ্রনাথকে কিছুদিন পর নর্মাল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন l
এই স্কুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন  - নর্মাল স্কুলের স্মৃতিটা কোনও অংশেই লেশমাত্র সুমধুর নহে l আমরা তখন ছাত্র বৃত্তি ক্লাসের একক্লাস নিচে বাংলা পড়িতেছি l এই সময়ে আমাদের নর্মাল স্কুলের পালা হঠাৎ শেষ হইয়া গেল l
নর্মাল স্কুলেও মন না টেঁকায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অভিভাবকরা বালক রবীন্দ্রনাথকে বেঙ্গল একাডেমি স্কুলে ভর্তি করে দেন l এই স্কুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  - সেখানে কী যে পড়িতেছি,তাহা কিছুই বুঝিতাম না l পড়াশোনা করিবার কোনও চেষ্টাই করিতাম না l না করিলেও বিশেষ কেহ লক্ষ্য করিত না l এই বিদ্যালয়ে আমার মতো ছেলের একটা মস্ত সুবিধা ছিল এই যে আমরা যে লেখাপড়া করিয়া উন্নতি লাভ করিব সেই অসম্ভব দুরাশা আমাদের সম্বন্ধে কাহারও মনে ছিল না l নানা ছল করিয়া বেঙ্গল একাডেমি হইতে পলাইতে আরম্ভ করিলাম l
এরপরে রবীন্দ্রনাথকে ১৮৭৪সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করা হয় l ছাত্র রবি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ত্যাগ করেন ১৮৭৬ সালে l অর্থাৎ কবির পনের বছর বয়েসে l

এই সময়ে ঠাকুর বাড়ির বয়:জ্যেষ্ঠ কড়া অভিভাবকরা লেখাপড়ায় নিতান্ত অবহেলার জন্য কিশোর রবিকে তিরস্কার করেন l তাঁর সম্পর্কে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অভিভাবকরা তাঁকে লেখাপড়ার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দেন l
বিলেতযাত্রা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  - কথা ছিল পড়াশোনা করিব, ব্যারিস্টার হইয়া দেশে ফিরিব, তাই একদিন ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হইলাম l এই স্কুলেও আমার বেশিদিন পড়া চলিল না l

এর কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন l তিনি এখানে মাত্র তিনমাস পড়েছিলেন l এখানেই ছাত্র রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত লেখপড়ায় ইতি l এরপরে তিনি আর ছাত্র হিসেবে ইস্কুল কলেজমুখী হননি l
কেন ইস্কুলের প্রতি বাল্যকালে, কৈশোরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রাবস্থায়  ? তা তিনি নিজেই বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন l
এই প্রসঙ্গে 'জীবন স্মৃতি ' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  - নর্মাল স্কুলের ঘরগুলা নির্মম, ইহার দেয়ালগুলা পাহারাওয়ালার মতো, ইহার মধ্যে বাড়ির ভাব কিছুই নাই, ইহা খোপওয়ালা একটা বড় বাক্স l কোথাও কোনও সজ্জা নাই, ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করিবার লেশমাত্র চেষ্টা নাই l ছেলেদের যে ভালো মন্দ লাগা বলিয়া একটা খুব মস্ত জিনিস আছে, বিদ্যালয় হইতে সে চিন্তা একেবারে নি:শেষে নির্বাসিত l সেই জন্য বিদ্যালয়ের দেউড়ি পার হইয়া তাহার সংকীর্ণ আঙিনায় পা দিবামাত্র তৎক্ষণাৎ সমস্ত মন বিমর্ষ হইয়া যাইত l অতএব ইস্কুলের সঙ্গে আমার সেই পালাইবার সম্পর্ক আর ঘুচিল না l

 এই কারণে,  পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সাথে লেখাপড়ার মেলবন্ধন করে শিশু পড়ুয়াদের হৃদয় এবং মনকে আকৃষ্ট করার জন্য ১৯০১সালে শান্তিনিকেতনে 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম 'স্থাপন করেন l
সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন  - আমার নিজের একটি স্কুল আছে এবং সেখানে ছাত্রেরা নানা প্রকার অপরাধ করিয়া থাকে l কারণ অপরাধ করা ছাত্রদের ধর্ম l যদি আমাদের কেহ তাহাদের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ ও ভীত হইয়া বিদ্যালয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় অসহিষ্ণু হন ও তাহাদিগকে সদাই কঠিন শাস্তি দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ওঠেন, তখন আমার নিজের ছাত্র - অবস্থার সমস্ত পাপ সারি সারি দাঁড়াইয়া আমার মুখের দিকে তাকাইয়া হাসিতে থাকে l
বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে বোধহয় ভালোই করেছিলেন l তিনি যদি ব্যারিস্টার রবীন্দ্রনাথ টেগোর হয়ে বিলেত থেকে দেশে ফিরতেন, তাহলে রবীন্দ্রপ্রতিভার আশ্চর্য বিচ্ছুরণ হয়তো আদৌ ঘটতো না l আমরা পেতাম না বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি লেখককে l
ads banner


ads banner

Bangla eDaily to resume soon