তুষার ভট্টাচাৰ্য
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির অভিভাবককুলের নিরন্তর শাসন, লেখাপড়ার জন্য চাপ প্রভৃতির কারণে শৈশবে রবীন্দ্রনাথ খুঁজেছিলেন অনাবিল মুক্তির আনন্দ, তাইরে নাইরে করে ঘুরে বেড়ানোর l কিন্তু তিনি তা কখনও পাননি l তাই তাঁর শৈশবের দিনগুলি খুব বেশি আনন্দময় ছিল না l
বস্তুত, বালক রবীন্দ্রনাথের ইস্কুলের প্রথাগত শিক্ষা কোনোদিনই ভাল লাগে নি l এই কারণে তাঁর বাল্যকালে অনেকবার ইস্কুল পাল্টানোর ঘটনা ঘটেছে l যদিও বালক রবির কোথাও মন টিঁকেনি l
এই প্রসঙ্গে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'ছেলেবেলা' প্রবন্ধ গ্রন্থের শুরুতেই ' বালক 'কবিতায় লিখেছেন -
কিশোরী চ্যাটুজ্যে হঠাৎ জুটত সন্ধ্যা হলে
বাঁ হাতে তার থেলো হুঁকো, চাদর কাঁধে ঝোলে
দ্রুতলয়ে আউড়ে যেত লবকুশের ছড়া,
থাকতো আমার খাতা লেখা পড়ে থাকতো পড়া ;
পরিণত বয়েসে, বিদ্যালয়কে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে হাসপাতাল আবার কখনও জেলখানা l সেই কারণে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের মোট চারবার ইস্কুল পাল্টাতে হয়েছে l বারবার ইস্কুল পাল্টানো প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গভীর আক্ষেপ করে লিখেছেন - যে বিদ্যালয় চারিদিকের জীবন ও সৌন্দর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন জেলখানা ও হাসপাতাল জাতীয় একটি নির্মম বিভীষিকা তাহার নিত্য আবর্তিত ঘানির সঙ্গে কোনোমতেই আপনাকে জুড়িতে পারিলাম না l যখন আমার বয়েস তেরো, তখন এডুকেশন বিভাগীয় দাঁড়ের শিকল ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েছিলাম l
প্রসঙ্গত, ছাত্র রবীন্দ্রনাথের প্রথম লেখাপড়া শুরু হয় কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে l এই স্কুল প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন - পড়া বলিতে না পারিলে বেঞ্চে দাঁড় করাইয়া তাহার দুই প্রসারিত হাতের উপর ক্লাসের অনেকগুলি শ্লেট একত্র করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইত l
ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল ভাল না লাগায়, বাড়ির কড়া অভিভাবকরা, বালক রবীন্দ্রনাথকে কিছুদিন পর নর্মাল স্কুলে ভর্তি করে দিলেন l
এই স্কুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন - নর্মাল স্কুলের স্মৃতিটা কোনও অংশেই লেশমাত্র সুমধুর নহে l আমরা তখন ছাত্র বৃত্তি ক্লাসের একক্লাস নিচে বাংলা পড়িতেছি l এই সময়ে আমাদের নর্মাল স্কুলের পালা হঠাৎ শেষ হইয়া গেল l
নর্মাল স্কুলেও মন না টেঁকায় জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অভিভাবকরা বালক রবীন্দ্রনাথকে বেঙ্গল একাডেমি স্কুলে ভর্তি করে দেন l এই স্কুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - সেখানে কী যে পড়িতেছি,তাহা কিছুই বুঝিতাম না l পড়াশোনা করিবার কোনও চেষ্টাই করিতাম না l না করিলেও বিশেষ কেহ লক্ষ্য করিত না l এই বিদ্যালয়ে আমার মতো ছেলের একটা মস্ত সুবিধা ছিল এই যে আমরা যে লেখাপড়া করিয়া উন্নতি লাভ করিব সেই অসম্ভব দুরাশা আমাদের সম্বন্ধে কাহারও মনে ছিল না l নানা ছল করিয়া বেঙ্গল একাডেমি হইতে পলাইতে আরম্ভ করিলাম l
এরপরে রবীন্দ্রনাথকে ১৮৭৪সালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি করা হয় l ছাত্র রবি সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ত্যাগ করেন ১৮৭৬ সালে l অর্থাৎ কবির পনের বছর বয়েসে l
এই সময়ে ঠাকুর বাড়ির বয়:জ্যেষ্ঠ কড়া অভিভাবকরা লেখাপড়ায় নিতান্ত অবহেলার জন্য কিশোর রবিকে তিরস্কার করেন l তাঁর সম্পর্কে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির অভিভাবকরা তাঁকে লেখাপড়ার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দেন l
বিলেতযাত্রা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - কথা ছিল পড়াশোনা করিব, ব্যারিস্টার হইয়া দেশে ফিরিব, তাই একদিন ব্রাইটনে একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হইলাম l এই স্কুলেও আমার বেশিদিন পড়া চলিল না l
এর কিছুদিন পরে রবীন্দ্রনাথ লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন l তিনি এখানে মাত্র তিনমাস পড়েছিলেন l এখানেই ছাত্র রবীন্দ্রনাথের প্রথাগত লেখপড়ায় ইতি l এরপরে তিনি আর ছাত্র হিসেবে ইস্কুল কলেজমুখী হননি l
কেন ইস্কুলের প্রতি বাল্যকালে, কৈশোরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছাত্রাবস্থায় ? তা তিনি নিজেই বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন l
এই প্রসঙ্গে 'জীবন স্মৃতি ' গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - নর্মাল স্কুলের ঘরগুলা নির্মম, ইহার দেয়ালগুলা পাহারাওয়ালার মতো, ইহার মধ্যে বাড়ির ভাব কিছুই নাই, ইহা খোপওয়ালা একটা বড় বাক্স l কোথাও কোনও সজ্জা নাই, ছেলেদের হৃদয়কে আকর্ষণ করিবার লেশমাত্র চেষ্টা নাই l ছেলেদের যে ভালো মন্দ লাগা বলিয়া একটা খুব মস্ত জিনিস আছে, বিদ্যালয় হইতে সে চিন্তা একেবারে নি:শেষে নির্বাসিত l সেই জন্য বিদ্যালয়ের দেউড়ি পার হইয়া তাহার সংকীর্ণ আঙিনায় পা দিবামাত্র তৎক্ষণাৎ সমস্ত মন বিমর্ষ হইয়া যাইত l অতএব ইস্কুলের সঙ্গে আমার সেই পালাইবার সম্পর্ক আর ঘুচিল না l
এই কারণে, পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সাথে লেখাপড়ার মেলবন্ধন করে শিশু পড়ুয়াদের হৃদয় এবং মনকে আকৃষ্ট করার জন্য ১৯০১সালে শান্তিনিকেতনে 'ব্রহ্মচর্যাশ্রম 'স্থাপন করেন l
সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - আমার নিজের একটি স্কুল আছে এবং সেখানে ছাত্রেরা নানা প্রকার অপরাধ করিয়া থাকে l কারণ অপরাধ করা ছাত্রদের ধর্ম l যদি আমাদের কেহ তাহাদের ব্যবহারে ক্রুদ্ধ ও ভীত হইয়া বিদ্যালয়ের অমঙ্গল আশঙ্কায় অসহিষ্ণু হন ও তাহাদিগকে সদাই কঠিন শাস্তি দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ওঠেন, তখন আমার নিজের ছাত্র - অবস্থার সমস্ত পাপ সারি সারি দাঁড়াইয়া আমার মুখের দিকে তাকাইয়া হাসিতে থাকে l
বস্তুত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে বোধহয় ভালোই করেছিলেন l তিনি যদি ব্যারিস্টার রবীন্দ্রনাথ টেগোর হয়ে বিলেত থেকে দেশে ফিরতেন, তাহলে রবীন্দ্রপ্রতিভার আশ্চর্য বিচ্ছুরণ হয়তো আদৌ ঘটতো না l আমরা পেতাম না বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবি লেখককে l