লিয়াকত হোসেন খোকন
ব্রিটিশরা ভারত -বাংলাদেশে এসেছিল, এই উপমহাদেশটাকে লুঠ করেছে। মণিমুক্তা, স্বর্ণালংকার -সহ মূল্যবান সবকিছু লুঠ করে নিয়েছে একে একে। ২০০ বছর রাজত্ব করার পর ভারতীয়রা ওদের তাড়িয়ে দিয়েছে। এ যুগে বাংলাদেশের কতিপয় বাংলাদেশি ও ভারতের ভারতীয় নিজেদের দেশে লুঠ করছে আর এই লুঠেরাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিচ্ছে ব্রিটেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের বহু অপরাধীদেরকে ষড়যন্ত্র -কুৎসা ছড়ানোর জন্য ব্রিটেন তাঁদের দেশে আশ্রয় দিয়েছে। মাঝেমধ্যে তাঁদেরকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলতে সহযোগিতা করে যাচ্ছে ব্রিটেনরাই। পাছে বাংলাদেশে থাকলে মার খান, তাই বাংলাদেশের অপরাধীদের আদ্যশ্রাদ্ধ করে যাচ্ছে ব্রিটেনরা। "ঔপনিবেশিক প্রথা মিটেছে
খাতায় -কলমে। এখনও বাংলাদেশ -ভারত উভয় দেশই শাসন ব্রিটেনের ওপর ভর করে আছে । " এ কথাগুলি ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন ট্যুইট করে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন।
রঘুরাম রাজনের মতে, " ব্রিটিশরা আজও মনে করে, ভারত -বাংলা তাঁদের উপনিবেশ ও ভারতীয় -বাঙালিরা তাঁদের বংশবদ প্রজা, দেখামাত্রই স্যালুট ঠুকবে, সাহেবদের মুখের ওপর কোনো কথা বলবে না, তেমন ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রনায়করাও আজো মনে করেন, প্রভুদের চটানো যাবে না। ক্রীতদাসদের সংগঠন কমনওয়েলথের সদস্য না থাকলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। মহামান্য ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী আমাদের একমাত্র ত্রাতা। "
আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গত ৭৫ বছর ধরে ব্রিটেন পেছন থেকে যাবতীয় খড়কে কাঠি নেড়ে কি যাচ্ছে না? আর দাস মানসিকতার ভীরুদের যা হয়, সেভাবেই অম্লানবদনে উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলি সব মেনে কি চলছে না?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ; বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনী ; একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার মূল আসামি -সহ বড় বড় অপরাধীর দল ব্রিটেনে গিয়ে বহাল তবিয়তে থাকার ব্যবস্থা পেয়েছে। সেই অপরাধী -লুঠেরারা জানে, ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো মহারথী নেই যিনি ব্রিটেনকে চটিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারবেন। সেকালে অপরাধ করে বহু অপরাধীরা যেমন সারা জীবন ব্রিটেনে আরামে কাটিয়েছিলেন, একালেও তেমনই
একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলার প্রধান আসামী ও সাজাপ্রাপ্তরা ছাড়াও অনেক অপরাধীরা ব্রিটেনে গিয়ে রাজকীয় আরামে দিন কাটাচ্ছেন। মদ খাচ্ছেন, জুয়া খেলছেন, নারী নিয়ে আনন্দ ফূর্তি করে যাচ্ছেন। আর এই চক্র ব্রিটেনে বসে ব্রিটিশদের সহায়তায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ব্রিটেনে বসে ষড়যন্ত্রকারীরা ইউটিউবের মাধ্যমে এমন সব অশ্লীল কথাবার্তা বলে, যা শুনতে গিয়ে আপসেই চোখ -কান বন্ধ হয়ে আসে। আর সেই সব ভিডিওগুলি শেয়ার করে কতিপয় দেশদ্রোহীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারগুলি নাকি রেড কর্নার নোটিশ জারির জন্য ইন্টারপোলের কাছে দরবার করছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কারণ, ব্রিটেন চিরকাল ধরে কূটচালের খেলা করে যাচ্ছে।
গ্রেট ব্রিটেন যে অপরাধীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে আসছে, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। একটু পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ব্রিটেন আজও মনে করে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তাঁদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু ও রাসবিহারী বসু। তাই ভারতের জওহরলাল নেহেরু থেকে একালের নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ক্ষতি হওয়ার দোহাই পেড়ে এঁদের সম্বন্ধে বেশ কিছু তথ্য আজও চেপে রেখে দিয়েছেন। নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু সম্বন্ধে ব্রিটিশের কড়া শর্ত ছিল, তিনি দেশে ফিরলে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবন্দির চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দি হিসাবে তাঁকে ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতে হবে। সেসময়ের ভারতের গণপরিষদের সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা মেনে নিয়েছিলেন।
ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করার পর ভারতে যেমন অশান্তি লেগে রয়, তেমনি অশান্তি ছিল পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নিপীড়ন আর শোষণ চালায়। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুঠ করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা, তাই পূর্ব পাকিস্তানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন। অবশেষে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা একটি দেশ " বাংলাদেশ " গড়ে তুলতে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালে হিন্দু -মুসলমান মিলে একই জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধ করে। ত্রিশ লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশ গড়ে উঠল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে যারা লুঠপাট করেছিল, সেই অপরাধীদেরকে ব্রিটেন আশ্রয় দিয়েছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের উত্থানে ব্রিটেন যে কলকাঠি নাড়েনি, তা কে-ই বা জানে। হিন্দু সম্প্রদায় ৩৩ শতাংশ থেকে ৭ শতাংশে পৌঁছেছে, এর পেছনেও কি ব্রিটেনের কূটচাল?
আরও পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রনায়কদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরও উত্তর -পূর্ব সীমান্তে যাতে চিরকাল অশান্তি লেগে থাকে তার ব্যবস্থা চিরকালের জন্য করে রেখেছিল। কাশ্মীর নিয়ে যাতে চিরকাল গোলমাল থাকে, সেই পাকাপাকি ব্যবস্থাও ব্রিটিশদের অবদান। চিনের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা তৈরির উদপাতাও ব্রিটেন। বার্মা সীমান্তে নাগাল্যান্ডের জনসাধারণের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন নাগাল্যান্ড গড়ার মূল হোতা আঙ্গামি জাপু ফিজোর পেছনেও মূল মদতদাতা ছিল ব্রিটেন। নাগাল্যান্ডের বিদ্রোহ দমাতে একসময় জওহরলাল নেহেরুকে ব্রিটেনের দ্বারস্থ হতে হয়। ব্রিটেনের এর পরের খেলা আরো আশ্চর্যজনক। ব্রিটেন একদিকে জওহরলাল নেহেরুকে মুখে বলল, গ্রেপ্তারের হুলিয়া জারি করে ফিজোকে গ্রেপ্তার করুক। অন্যদিকে, ফিজোকে লন্ডনে ডেকে এনে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয় ব্রিটেন। এ হল একইসঙ্গে সাপের ও ব্যাঙের মুখে চুমু খাওয়ার নীতি। ফিজো যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত তিনি বহাল তবিয়তে আরাম-আয়েশে লন্ডনে ছিলেন। জওহরলাল নেহেরু থেকে রাজীব গান্ধী পর্যন্ত কেউ তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেননি।
আরো মজা হল, ব্রিটেনের রাজ পরিবারের লোকেরা আজও ভিসা ছাড়াই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রজাদের বংশধরদের দেখতে এই উপমহাদেশে আসতে পারেন। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের ভারত, নেপাল, ভূটান আর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিটেনে যেতে হলে ভিসা নিতে হয়। এহেন দাসত্ব করার জন্যই ক্ষুদিরাম বসু, ভগৎ সিং,
যতীন দাস, মহাবীর সিং, মোহিত মোহন মৈত্র, পণ্ডিত রামরক্ষা, অনিলকুমার দাস, কনকলতা, মাতঙ্গিনী হাজরা, ভারিয়ানকুন্নাথু কুঞ্জাহামেদ হাজী, সূর্যসেন ও প্রীতিলতারা আত্মত্যাগ করেছিলেন? আশ্চর্য আমাদের দেশপ্রেম! কবে আর সাহেবদের তোষামোদ করা বন্ধ করতে শিখব?