ADVT

বাইশে শ্রাবণ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের শিখা নিভে গিয়েছিল


বটু কৃষ্ণ হালদার

একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারত বর্ষ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও ভাষাভাষী র দেশ। সেইসঙ্গে ভিন্ন সংস্কৃতির দেশ। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমানা বুঝিয়ে দেয় ভাষা সংস্কৃতির বহুত্ব ভৌগোলিক সীমাকে পরোয়া করে নাসম্প্রদায় কেন্দ্রিক ধর্মকে। বৈচিত্র্যময় ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সীমায় হিন্দু,ইসলামবৌদ্ধ খ্রিস্টান ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী মানুষের জন্য আলাদা আলাদা দেবদেবী। কারো সাকার কারো আবার নির্বিকার। যেখানে সমগ্র ভারতবর্ষ  আপন আপন ধর্মের অহংকারে বলিয়ান হয়ে উঠছে সেখানে বলার অপেক্ষা রাখে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব সময়ই মানব ঐক্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মানুষের সভ্যতা সমাজনীতি রাষ্ট্রনীতি ধর্মতত্ত্ব সবকিছুকে তিনি সত্যের আদর্শে বিচার করার কথা বলেছেন। তিনি আরো বলেছেন আমাদের একটাই দেশ তা হল বিশ্ব। একটাই জাতি তা হল মানব জাতি আর একটাই ভাষা তা হল মানব ভাষা।একটাই ধর্ম তা হল মানব ধর্ম। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্ন সবার সম্মুখে আসে তা হল:_তবে পৃথিবীতে কেন ভাষার জন্য ক্ষমতার জন্য ধর্মের জন্য এত হানাহানি?এত রক্তপাত? এই কথার উত্তর খুঁজতে গিয়ে যা প্রথমে আসে তা হল ভারতের প্রধান দুটি সমস্যা হল ভাষাগত এবং ধর্মগত। আমরা কখনোই ভাবতে পারিনা যে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষা আমাদের ভাষা কখনোই ভাবতে পারি না যে নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য মানুষের ধর্ম ও আমাদের ধর্ম। আমাদের মূলে রয়েছে সমতার অভাব সমস্যার সমাধানের প্রতি অনিহা। তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মনে করেছেন সকল মানুষের উপলব্ধি সমান নয় মানুষের মনের বিকৃতি কাজ করছে রক্তপাত হানাহানির মূলে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে ভারতের ভৌগোলিক সীমানা হল সমতল। অসামঞ্জস্য ভেদাভেদের কথা তিনি ভাবতেই পারেন না। তাই সকল ধর্মের কথা মাথায় রেখে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন করেছিলেন শান্তিনিকেতনে। একথা হয়তো অনেকেই জানি তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ গিয়েছিলেন এবং সেটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় বার ইউরোপ ভ্রমণ। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি একটি সভা ডেকেছিলেন। সেই সবার সভাপতি আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল গুরুদেবের আসল উদ্দেশ্য র কথা সম্মু খে এনেছিলেন। বিশ্বভারত সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ   ে ঠাকুরের ভাবনাটা ছিল ঠিক এইরকম:_"বিশ্বভারতীর আক্ষরিক অর্থের দ্বারা আমরা বুঝি যে "ভারতী" একদিন অলক্ষিত হয়ে কাজ করেছিলেন। আজ তিনি প্রকট হলেন কিন্তু এর মধ্যে আরেকটি ধনী গত অর্থ আছে_বিশ্ব ভারতের কাছে এসে পৌঁছবে সেই বিশ্বকে ভারতীয় করে নিয়ে আমাদের রক্তরাগে অনুরঞ্জিত করে ভারতের মহা প্রাণে অনুপ্রাণিত করে আবার সেই প্রাণকে বিশ্বের কাছে উপস্থিত করবো"।

ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় গুরুদেব এই রকম কথা বলতে কোন দর্শনের পৌঁছে গিয়েছিলেন তা কল্পনার অতীত। কারণ তিনি মনে করতেন যে সমগ্র বিশ্ব ভারতের কাজে এসে পৌঁছাবে আর ভারত থেকে প্রাণ বায়ু নেবে।অনুরঞ্জিত  ভারতের শুদ্ধ বায়ু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাবে। তাইতো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে বিশ্বভারতী পরিচালনা করেছিলেন। তিনি হিন্দু সংহিতার বিরোধিতা করে বিশ্বভারতীতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের বিদ্যা চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন। তিনি ধর্মীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে শুরু করেন মনুষ্যত্বের মধ্যে।

 "মনুষ্যত্ব" প্রবন্ধের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক একই রকম করে মানুষের আত্মসৃজনের ব্যাখ্যা করেছেন। তবে অনেকেই বলেছেন বেদের অনগমনই হল ধর্ম। তবে এই কথা যদি সত্যি হয় নিশ্চিত রূপে ইসলাম,খ্রিস্টান,বৌদ্ধ,জৈন এরা কোনটাই ধর্মের সংজ্ঞায় পড়ে না।কিন্তু সমগ্র বিশ্বের মানুষ জানে এগুলোই প্রকৃত ধর্ম। এইসব ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে বহু আছে। আসলে পৃথিবী বেশিরভাগ মানুষই ধর্মের সঙ্গে রিলিজিয়নকে একাকার করেছেন।"আমাদের ধর্ম রিলিজিয়ন নহে",রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর "ধর্মপ্রচার" প্রবন্ধে দীপ্ত কণ্ঠে এ কথা ঘোষণা করেছেন।তাঁর মতে ধর্ম হলো মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্বেচ্ছাচারিতার কোন জায়গা নেই ধর্মের মধ্যে।ধর্ম আনন্দের সঙ্গে যুক্ত অনুভূতি।নিভৃত সাধনার মধ্য দিয়ে ধর্ম সার্থকতা লাভ করে।আর রিলিজিয়নের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আস্থার সমষ্টি যা কিনা বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে অসহিষ্ণুতার ইতিহাস গড়ে তোলে। সেহেতু আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না পৃথিবীতে আজ মানুষের যে বিরোধ হানাহানি যুদ্ধ তা শুধু রিলিজিয়নের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। ধর্মের মহৎ উদ্দেশ্য না বুঝতে পারার কারণে ধর্ম গভীর সংকটের মধ্যে পড়ছে। বৃহৎ অর্থে না দেখে ধর্মকে দেখানো হয়েছে সংকীর্ণ অর্থে রিলিজিয়নের সঙ্গে এক করে। গুরুদেব কখনোই ওই সংকীর্ণ অর্থকে ধর্ম হিসেবে দেখেননি। তিনি বুঝিয়েছিলেন ধর্ম হলো ঐহ্যিক ও পারমার্থিক প্রাপ্তির মাধ্যম।

তবে এক্ষেত্রে বলতে বাধা নেই রবীন্দ্রনাথের পূর্বেই রামমোহন রায় প্রথম রিলিজিয়নের সঙ্গে ধর্মের পার্থক্য সূচনা করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ সেই ধারণাকে আরো পূর্ণতার রূপ দেন। তবে শুধু রামমোহন রায় নয়,রবীন্দ্রনাথের মনে ধর্ম বোধ জাগাতে বাংলার মহান মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর,অক্ষয় কুমার দত্ত,বঙ্কিমচন্দ্র এবং তাঁর বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব স্পষ্ট। সত্যেন্দ্রনাথ রায় তাঁর ধর্মচিন্তা রবীন্দ্র রচনার সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় জানিয়েছেন যে:_"রামমোহনের স্বাধীন বুদ্ধি,নব্যবঙ্গের তরুণদের প্রখর যুক্তি,উদ্ধত অবিশ্বাস, বিদ্যাসাগর,অক্ষয় কুমার দত্তের মুক্ত বুদ্ধি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ অনুভূতি,বঙ্কিমচন্দ্রের যুক্তিবাদ,দেশী ধ্রুববাদ, বিজ্ঞান মুখিতা_ এই শতসমুদ্র ধারার পরিমণ্ডলের রবীন্দ্রনাথের ধর্মচিন্তার উন্মেষ"।

রবীন্দ্রনাথের মতে ধর্মের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব হল  ঔপনিষদ ভিত্তিক।এই সাধনাতেই তিনি শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যা সম্প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তৃতীয় পর্বের রয়েছে ব্রহ্ম ভাবনা উপলব্ধির বিষয়।যার ফলে তিনি লিখলেন "শান্তিনিকেতন" গ্রন্থ। চতুর্থ পর্বে রয়েছে মগ্নতা। এখানেই তার ধর্ম ভাবনায় যুক্ত হয়েছে বহির্বিশ্ব। এই পর্বে তিনি অনুভব করেছেন বাইরের কোন কিছুর মধ্যে মনের মানুষ নেই। যা আছে নিজে নিজে অন্তরে।অর্থাৎ মন্দির, মসজিদ, গির্জা নয় মনের মানুষের অবস্থান মনে। বলা যায় এখান থেকেই তিনি ধর্মবোধে যাবার চূড়ান্ত পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।"গীতাঞ্জলি"র গান তো তিনি এই পর্বে লিখেছিলেন। নোবেল পাওয়ার সময় থেকেই রবীন্দ্র মরণে বিশ্ববোধের সমন্বয় হয়েছিল। আর পঞ্চম পর্বের দেখা গেল মানব ধর্মের (দা রিলিজিয়ন অফ ম্যান) কথা। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যে হীবার্ট বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার থেকেই এই ভাবনার সূচনা হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন। ষষ্ঠ ও শেষ পর্বের কথা হল মানব ধর্মের সাধনা।হিন্দু,ইসলাম,বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান নয় মানুষের ধর্ম হলো মানব ধর্ম যা এক কথায় শুভ কল্যাণকর মঙ্গলময়। একদিকে মানুষ অন্যদিকে মানুষের ধর্ম, একটি ছাড়া অন্যটির কোন অস্তিত্ব নেই। নিঃশ্বাস ছাড়া মানব দেহ যেমন অস্তিত্বহীন জল ছাড়া মাছ যেমন অচল তিনি সেই বাণী শুনিয়ে গেছেন। এই পর্বে অনেক আগেই আত্মপরিচয় গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট বলেছেন_"মানুষের আর একটি প্রাণ আছে,সেটা শরীর প্রাণের চেয়ে বড়। এই প্রাণের ভেতরকার সৃজনী শক্তি হচ্ছে তাঁর ধর্ম। মানুষের ধর্মটি হচ্ছে তার অন্তরতম সত্য"।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অসীম সসীমের মিলনক্ষেত্র। পার্থিব ইহা জগতের অন্যতম মহামানব।যিনি বিশ্বকবি রবি ঠাকুর নামে পরিচিত হয়েছিলেন আছেন এবং আগামী ভবিষ্যতেও থাকবেন।

এই ধর্মচিন্তার বিবরণীতে প্রশ্ন জাগতেই পারে রবি ঠাকুরের মনে কে বা কারা এই ধর্মের সূচনা করেছিলেন?উত্তরে বলা যায় অবশ্যই বিদেশি মানবতাবাদ কাজ করেছিল। কারণ তিনি কোনখানে মহর্ষি,শ্রীরামকৃষ্ণ বা শ্রী অরবিন্দের মত সাধক ছিলেন না।তাঁদের ধর্ম বোধ রবীন্দ্রনাথকে নাড়া দেয়নি। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না তাঁর ধর্ম জুড়ে ছিল হৃদয় অনুভূতি উপলব্ধি ইত্যাদি। এই বিশ্বাস তাঁকে মানবক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করিয়েছিল। ফলস্বরূপ তিনি পেয়েছিলেন অখন্ড চেতনা অনুসন্ধান করার এক অমোঘ শক্তি।তাছাড়াও রাজারামমোহন রায়ের মানবককেন্দ্রিক দর্শন রবীন্দ্র মানুষের যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল তৎকালীন সময়ে।রামমোহনই তো সর্বপ্রথম গতানুগতিক ধারণাতে নাড়া দিয়েছিলেন।কুসংস্কার ময় অন্ধকার জগত থেকে মানুষকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন।থেমে যাওয়া নয় এগিয়ে চলার মধ্যেই রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ততা। তাইতো রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:_যে নদী হারায়ে  স্রোত চলিতে না পারে/সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে/যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়/পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকচার"।

বাইশে শ্রাবণ সমগ্র ভারতবর্ষের নেমে এসেছিল শোকের ছায়া। শুধু ভারতবর্ষে বলা হয় তো ভুল হবে।সমগ্র বিশ্ববাসীর হৃদ স্পন্দন সেদিন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।কারণ জাগতিক নিয়ম অনুসারে মৃত্যু নাম ক সত্যবাদের কাছে ধরা দিয়েছিল নশ্বর দেহটা। বাইশে শ্রাবণ বেলা বারোটা বেজে দশ মিনিটে বিদায় ঘন্টা বেজে উঠেছিল কলকাতার বিশ্ব বিখ্যাত জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে।ছন্দপতন ঘটেছিল মহা ধুমকেতর। সবার প্রিয় গুরুদেব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছিলেন ইহা লোকের মায়া ত্যাগ করে।সেই সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা সাহিত্য অভিভাবকহারা হয়েছিলেন।তাই ক্যালেন্ডারে বাইশে শ্রাবণ শুধু মাত্র একটা দিবস হলেও সমগ্র ভারত বর্ষ তথা বিশ্বের কাছে এই দিনটা অত্যন্ত দুঃখের।ওই দিনে এক মহামানবের মহাপ্রস্থান ঘটেছিল। যা মেনে নেওয়া আর বুকের উপর পাথর চাপিয়ে রাখা দুটোই সমান। কিন্তু সময় তো সময়ের পথ ধরে চলবে।আর মৃত্যু হল চিরন্তন সত্য যাকে উপেক্ষা করার মত সাহস কারও নেই।

বাঙালির প্রাণের  কবি নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও অসামান্য রচনা ও কাজের মধ্যে আজো বেঁচে আছেন তিনি প্রেরণা-দাতা হয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমুখী সৃজনশীলতা  বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সব কটি শাখাকে স্পর্শ করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তার লেখা গান বাঙালির হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় আজো। আনন্দে, বেদনায় এমনকি দ্রোহে এখনও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির প্রেরণার উৎস। রবীন্দ্রনাথ আমাদের মন-মানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন। তিনি কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় নন্দিত। ঊন-বিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে পৌঁছে দিয়েছে।তাই তাঁকে নিয়ে অতীত,বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও গবেষণা চলতে থাকবে এটাই চরম সত্য। কারণ তিনি শুধু বাহ্যিক রবি নন তিনি তো অন্তরের।

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী এই ঘাটে-গো’— কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের চিহ্ন না রইলেও তার রচনায় ভর করে খেয়াতরী বাওয়া ছাড়েননি কবি। 

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে নজরুলের বিষণ্ণ গলার গান শুনিয়েছিলে—"‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে’, মনে পড়ে তাঁর অজস্র কবিতার বিনম্র  পঙক্তিমালা"।

‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্ত-পথের কোলে

শ্রাবণের মেঘ ছুটে’ এল দলে দলে

            উদাস গগন-তলে,

বিশ্বের রবি, ভারতের কবি;

শ্যাম বাঙ্লার হৃদয়ের ছবি

            তুমি চলে যাবে বলে।’

নজরুল মনে করেন, ধরিত্রী মাতার কান্না শুনেই যেন রোগের ছলনা করে রবীন্দ্রনাথ আঁখি মুদে তাঁর কাছে চলে গেছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য বাংলার সর্বত্র ব্যথা জেগে উঠেছে। বাংলার সাগর, নদী, অরণ্য, সব তাঁর জন্য কাঁদছে। রবীন্দ্রনাথের লেখনী ধারণ করেছিলেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী, ধ্যানের আসনে ছিলেন শিব, হৃদয়ে ছিলেন প্রেমের দেবতা মদন। যে আনন্দময়ী রবীন্দ্রনাথের সাথে নিত্য কথা বলতেন, তিনি বা তাঁদের কেউ বঞ্চিত মানুষের ব্যথা বুঝলেন না। অথচ তাঁদের কৃপার দান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাংলার আশা-প্রদীপ, চির অম্লান, চির উজ্জ্বল। নজরুলের প্রশ্ন, কেমন করে তাঁরা তাঁদের কৃপার দানকে দিয়ে আবার নিয়ে গেলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের গর্বে গর্বিত ছিলেন, তাই পৃথিবীকে মৃৎপাত্রের ঢাকনা বা সরার মতো তুচ্ছ মনে করতেন, ক্লৈব্য-দীনতা-ক্ষুধা-জরা সব ভুলে থাকতেন। মাথার ওপরে সূর্যরশ্মির মতো রবীন্দ্রনাথ নিত্য জ্বলতেন। রবীন্দ্রনাথের গর্বে নজরুল ও অন্যরা এমনই গর্বিত ছিলেন যে, তাঁরা যে ভাগ্যাহত তা কখনো ভাবতেই পারেননি।তাইতো আবার যেন নতুন করে প্রাণ খুলে বলতে ইছে করে:_আজ বাইশে শ্রাবণ/মানে না তো মন/ঝিরিঝিরি বারিধারার সাথে তুমি ফিরে এসো/স্পর্শ করো আমার প্রানের দুয়ারে"।

বাইশে শ্রাবণ জীবনের পারাবার পেরিয়ে অনন্তের পথে যাত্রা----

চলে যাওয়া চিরতরে তবু এ তো যাওয়া নয়----

স্মৃতিপটে দাগ রেখে যায়----

সুখে দুঃখে মিলনে বিরহে

সমস্ত জাগতিক অনুভূতিতে তুমি এই বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে আছো আজও----

বাইশে শ্রাবণ সে অহঙ্কার আমাদের থেকে কোনদিনই কেড়ে নিতে পারবে না-----

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(02)

আলোচনা করুন, আলোচনায় থাকুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার আলোচনা তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !