বটুকৃষ্ণ হালদার
প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন: "আগে পাশ্চাত্যের সভ্য জাতিগুলি হিন্দু ধর্মকে অত্যন্ত হেয় করে দেখত। তারা মনে করত হিন্দু ধর্ম কুসংস্কার, দুরাচার, নীতিহীন, লোকাচারের সমষ্টি মাত্র। তাই প্রগতিশীল জগতে হিন্দু ধর্ম কোনরকম গুরুত্ব পাবার দাবি রাখতে পারেনা। চিকাগোতে আয়োজিত ধর্ম সভায় স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের স্বপক্ষে বক্তৃতা করে, বিশ্বসংস্কৃতির আধুনিক মানচিত্রে সেদিন তিনি হিন্দু ধর্মের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কি বিশ্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মকে তারা অত্যন্ত উঁচু আসন দিতে বাধ্য হয়েছিল"।
হিন্দুধর্ম একটি ভারতীয় উপমহাদেশীয় ধর্ম বা জীবনধারা।এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারী সংখ্যা ১.২ বিলিয়নেরও বেশি, বা বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার ১৫-১৬%, যারা হিন্দু নামে পরিচিত।হিন্দু শব্দটি একটি উচ্ছসিত,এবং যখন হিন্দুধর্মকে বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্ম বলা হয়, অনেক অনুশীলনকারী তাদের ধর্মকে সনাতন ধর্ম হিসাবে উল্লেখ করেন, যা এই ধারণাকে বোঝায় যে এর উৎস মানব ইতিহাসের বাইরে, যেমনটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। এ ধর্মের মূলে বেদ হওয়ায় এটি ‘বৈদিক ধর্ম’ নামেও পরিচিত।
হিন্দুধর্ম হল বিভিন্ন দর্শন এবং ভাগ করা ধারণা, আচার, বিশ্বতাত্ত্বিক ব্যবস্থা, তীর্থস্থান এবং ভাগ করা পাঠ্য উৎস দ্বারা চিহ্নিত একটি বৈচিত্র্যময় চিন্তাধারা যা ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, পুরাণ, বৈদিক যজ্ঞ, যোগব্যায়াম, আগমিক আচার এবং মন্দির নির্মাণ নিয়ে আলোচনা করে। ধর্মীয় আচারগুলো মূলত ধর্ম(নৈতিকতা), অর্থ(সমৃদ্ধি), কাম(আকাঙ্খা) ও মোক্ষ(ঈশ্বর প্রাপ্তি) এই চারটি অর্জনের লক্ষ্যে পালন করা হয়, যাকে একসাথে বলা হয় পুরুষার্থ,সেইসাথে আছে কর্ম এবং সংসার (মৃত্যু ও পুনর্জন্মের চক্র)। যজ্ঞ, ধ্যান, পূজা, কীর্তন, ইষ্টনাম জপা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দয়া, সংযম, ধৈর্য, প্রাণীর প্রতি অহিংসা ইত্যাদি চিরন্তন নৈতিক জীবনাচরণের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়।বাহ্যিক আচরণ পালন অপেক্ষা মোক্ষ প্রাপ্তির উপায়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়ে, যা অর্জনের জন্য কেউ কেউ জাগতিক বস্তুগত সম্পদ ত্যাগ করে সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করে থাকে।
সেই ধর্ম সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ''ধর্ম হল সেটাই, যা পশুকে মানুষে এবং মানুষকে দেবতায় পরিণত করে।'এর অর্থ হল,ধর্ম'হল একটি বিকাশের প্রক্রিয়া।পাশবিক মানুষের আনন্দ শুধু শরীরগত। শরীরের সুখ বা ইন্দ্রিয়চরিতার্থতা ছাড়া সে আর কিছুই বোঝেনা।আর একটু উন্নত হলে মানুষ মানসিক আনন্দলাভের অধিকারী হয়, তখন সে সাহিত্য রস,শিল্পের রস অনুভব করতে পারে। সুক্ষাতিসুক্ষ কর্মে আনন্দ লাভ করে। এটাকে মানবীয় স্তর বলা যায়।আরও উন্নত অবস্থায় মানুষ ঈশ্বরীয় আনন্দে বিভোর হয়,ধ্যানাবস্থায় শান্তির অপূর্ব পরিবেশ অনুভব করতে পারে;যাকে বলা যায় দৈবী স্তর"।
এভাবে উন্নত হতে হতে মানুষ যখন দেহ,মন ইন্দ্রিয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে তখনই সে লাভ করে শাশ্বত জ্ঞান বা সনাতন সত্য।সে অনুভব করে সে ক্ষুদ্র নয় সে দেহ নয়,মন নয় এমনকি চিন্তা চেতনাও নয়,সে 'আত্মা'।সে এক অনন্ত,অখণ্ড অস্তিত্ব। মানুষ তখন তার ক্ষুদ্রতার খোলস পরিত্যাগ করে অনন্ত'আমিত্বে'লীন হয়ে যায়।
'নির্গচ্ছতি জগজ্জালাৎ পিঞ্জরাদিব কেশরী, --সিংহ যেমন পিঞ্জর ভেঙ্গে ফেলে বেরিয়ে যায় ঠিক তেমনি সে এই জগৎ-জাল ভেদ করে মুক্ত হয়ে যায়।ধর্মের চরম লক্ষ্য'ই হল মুক্তি। ধর্ম হল এই রূপান্তরের প্রক্রিয়া, যা পশুকে মানুষে, মানুষকে দেবতায় এবং দেবতাকে ঈশ্বরে বিকশিত করে।ঋষিদের আবিষ্কৃত এই সত্যলাভের পথই সনাতন ধর্ম। সনাতন ধর্মকে বুকে আগলে রেখে মুনি,ঋষিরা যুগের পর যুগ পাহাড়ে,জঙ্গল তুষারের মাঝে বসবাস করে আসছে।সেখানে তারা যুগের পর যুগ সনাতন ধর্মের আরাধনা করে চলেছে। প্রাচীন সনাতন হিন্দু ধর্মে বেশকিছু নিয়মরীতি ধর্ম গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
হাতজোড় করে প্রণাম, নদী পার হওয়ার সময় নদীতে পয়সা ফেলা, সূর্য প্রণাম, বিবাহিত মহিলাদের সিঁদুর পরা, বড়দের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা,তেমন বহু নিয়ম রীতি প্রচলিত আছে।সেই সব নিয়মরীতি গুলোর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বিশেষ মিল পাওয়া যায়। তবে অনেকে এই নিয়ম নীতি মেনে চলেন, আবার অনেকে উপেক্ষা করেন।তবে প্রাচীন সনাতনী রীতি নীতি গুলো করোনা র ফলে আবার প্রকাশ্যে আসছে।এই করোনা কালে সমগ্র বিশ্ব যখন মৃত্যুর মিছিলে পথ হাঁটছে,ঠিক সেই মুহুর্তে বিশ্বের বেশ কিছু দেশ নমস্কার করা, মৃত লাশকে পুড়িয়ে ফেলা, মাথা মুন্ডন, শাল, পদ্ম, বা কলা পাতাতে ভাত খাওয়া সহ বিভিন্ন প্রাচীন রীতিকে আঁকড়ে ধরতে বাঁচতে চাইছে। এই সমস্ত প্রাচীন সনাতন ধর্মের মধ্যে তারা নিজেদের আত্মতৃপ্তি খুঁজে পাচ্ছেন। একসময় প্রাচীন ঋষি সংস্কৃতিকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বর্তমান ডিজিটাল যুগে।প্রাচীন রীতি নিয়ম অনুযায়ী শৌচালয় এবং স্নানের ঘর বাড়ির বাইরে বানানো হতো। চুল কাটার পর বা কোন মৃতদেহ সৎকার করে ঘরে ফেরার পর বাড়ির বাইরে স্নান করে ঘরে ঢুকতে হত । স্নানের পর আগুন স্পর্শ করে ঘরে ঢুকতে হতো।মৃত ব্যক্তি এবং দাহ সৎকার কারী ব্যক্তির বস্ত্র শ্মশানে ত্যাগ করার নিয়ম ছিল। চপ্পল বা জুতো ঘরের বাইরে রাখার নিয়ম ছিল। বাইরে দিয়ে এসে ঘরে প্রবেশের আগে বালতিতে রাখা জল দিয়ে হাত পা ধুয়ে ঘরে প্রবেশ করার নিয়ম ছিল।জন্ম বা মৃত্যুর পর সেই পরিবার ১০-১২ দিন যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারত না। সেই প্রাচীন সভ্যতায় বাড়ির মা-বোনেদের রান্না করার পূর্বে স্নান করতে হত। প্রাতঃকালে স্নান করে ঘরে ধুপ, ধুনা, কর্পূর,ঘন্টা শঙ্খ বাজানোর নিয়ম ছিল।এ সমস্ত নিয়ম কানুন আমরা নিজেরাই পরিত্যাগ করেছি। এই মুহূর্তে সামাজিক দূরত্ব থেকে শুরু করে হাত ধোয়া,পরিষ্কার,পরিচ্ছন্নতা কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে তা বোধহয় আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। এই সমস্ত সব নিয়ম রীতি লুকিয়ে আছে প্রাচীন সনাতনী সংস্কার গুলির মধ্যে।আধুনিক হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ সু_ সভ্যতা কে পদদলিত করে কু_ সভ্যতার দাসে পরিণত হয়েছে। যার ফলে বাড়ছে সংক্রমনের হার, খুব অল্প বয়সেই মৃত্যু ঘটছে, বাড়ছে বন্ধ্যত্বের হার, অল্প বয়সে যুবক-যুবতীদের চুলে পাক ধরেছে। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার মানুষজন ডাক্তার কিংবা ওষুধ ছাড়া এক পা ও চলতে পারে না। প্রাচীন সভ্যতা কিন্তু এমনটা ছিল না। সে সময় মানুষ শুদ্ধ সংস্কার মেনে চলা ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ সেবনের মধ্যে দিয়ে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় যে হিন্দু ধর্ম বিশ্ববাসীকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে, সেই ধর্ম সংখ্যা গুরুর দেশে তো বটেই,এমনকি বাঙালি সংস্কৃতির প্রধান স্থান পশ্চিম বাংলায় অসহায় ও প্রতিপন্ন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের দেশে হিন্দু ধর্মের অস্তিত্ব টিকে থাকলেও বহু মুসলিম দেশে আজ হিন্দু ধর্মের বিলুপ্ত হয়েছে।হিন্দু ধর্ম শুরু থেকেই শান্তি ও সম্প্রীতি ধর্ম। যে ধর্ম বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতি মেলবন্ধন রক্ষা করে আসছে,সেই ধর্ম কে বিলুপ্ত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুসলিম ধর্ম, সে নমুনা বোধহয় বিশ্বের ইতিহাসে কম নয়।আসলে এর প্রধান কারণ হলো শান্তিরক্ষাকারী হিন্দু ধর্ম নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মের নামে কখনো বন্দুক,কিংবা তলোয়ার হাতে তুলে নেয় নি। কখনোই হিন্দুরা মসজিদ ভাঙ্গার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি,জোর করে কাউকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টাও করেনি।কোনদিনই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কোন মুসলমান মা-বোনদের সম্ভ্রম নষ্ট করার কথা ভাবেনি।
প্রাচীন সনাতন হিন্দু ধর্ম শুধুমাত্র এক শ্রেণীর হিন্দুদের কাছে নয়,বিদেশীদের কাছে আবেগ ও ভালোবাসার মিশ্র অনুভূতি ।এই সনাতন হিন্দু ধর্মের টানে নিজের জন্ম ভূমি ছেড়ে বহু বিদেশীরা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। সেই সনাতন হিন্দু ধর্মকে ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ার সঙ্গে তুলনা করে সনাতন হিন্দু ধর্মীয় মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত করে রাজনৈতিক বৈতরণী পার করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার রাবণ,কংস,মুঘল, তুঘলক,ঘুরী সহ বহু হিন্দু বিদ্বেষী রাজারা প্রাচীন সনাতনী ধর্মকে ধ্বংস করতে চেয়েও পারেনি। নিজেদের বংশধর ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রাচীন ইরাক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান সহ বহু দেশে হিন্দু ধর্মকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রাচীন সনাতন ধর্ম বিশ্বের দুয়ারে ধজা উড়ালেও ওই সমস্ত দেশগুলো প্রায় ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছে। সে দিক থেকে বলতে গেলে বিশ্বের অন্যতম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া প্রাচীন সনাতন ধর্মকে সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে বিশ্বের মানচিত্রে ইন্দোনেশিয়া সফল ও উজ্জ্বলতম দেশ হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করেছে। ইন্দোনেশিয়াতে আছে বিশ্বের সবথেকে বড় সরস্বতী মন্দির আর ওই দেশের টাকাতে গণেশের ছবি বিদ্যমান।তাই কোন রাজনৈতিক দল যদি মনে করে থাকে সনাতন ধর্মকে আঘাত ও অপমান করে রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকবে তা দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।