বর্তমানে গণতন্ত্র হত্যাকারী, অসহিষ্ণু, বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাসবাদ, বেকার যুবকদের স্বপ্ন ধ্বংসকারী, আগ্নেয়াস্ত্রর নগরীর নাম হলো পশ্চিমবাংলা। তবে এসবের জন্য দায়ী জঘন্য রাজনীতি। স্বাধীনতা লাভের পর দেশের জনগণ অনেক স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। সমগ্র জনগণের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত রূপ দেওয়ার জন্য নির্বাচন পদ্ধতি শুরু হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেই থেকে এ যাবৎ ভোট হয়েছে সরকার গঠন হয়েছে। কিন্তু দেশের জনগণের দুর্দশা চরম সীমায় পৌঁছেছে। সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক এই দেশে পঞ্চায়েত, পৌরসভা, বিধানসভা ও লোকসভ, সহ একাধিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটি দেশে একাধিক নির্বাচন ব্যবস্থায় কোটি কোটি টাকা অর্থের অপচয় হয়। যে টাকা নির্বাচনী ব্যবস্থা যে অর্থ অপচয় হয় সেই টাকায় কয়েকটা কল-কারখানা গড়ে উঠে জনগণের দুর্দশা মোচনের রাস্তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু এই যাবৎ দেখা গেছে সরকার পরিবর্তন হলেও, বেড়েছে জনসংখ্যা কিন্তু বন্ধ হয়েছে হাজার হাজার কলকরখানা। ফলে বেড়ে চলেছে বেকারত্বের সংখ্যা। তার জন্য দুর্নীতি হুহু করে বেড়ে চলেছে। কারণ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে যুবসমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছে। অল্প পয়সার বিনিময়ে তাদের জীবনকে কিনে নেওয়া হচ্ছে। এটা তো গেল একটাদিক কিন্তু এযাবৎ প্রত্যেক নির্বাচনে ভারতবর্ষের বহু রাজ্যের মাটি লাল হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কর্মীদের রক্তে। তার মধ্যে অন্যতম নমুনা হলো পশ্চিমবাংলা। অর্থের কথা বাদ দিলাম কিন্তু যে মানুষগুলো মারা যায় তাদের জীবনের মুল্য কে দেবে?
পশ্চিমবাংলায় গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে ছিল নকশাল যুগ থেকে। তৎকালীন সময়ে বাংলার যুব ছাত্রদের মগজ ধোলাই করে শুরু হল শ্রেণীশত্রু লাল রক্তে রাঙানো লাল বিপ্লব। সেই রক্তাক্ত বিপ্লবকে নিজেদের স্বার্থের জন্য সম্পূর্ন সমর্থন করেছিল চিনের কমিউনিস্ট সরকার। চিনের পিকিং শহরের রেডিও থেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন করতে প্রচার করা হয়েছিল "ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার গ্রাম অঞ্চলের ভারতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের নেতৃত্বে কৃষকরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে। মাও সেতুঙের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এটা হচ্ছে ভারতীয় জনগণ দ্বারা সংঘটিত বৈপ্লবিক সশস্ত্র সংগ্রামের প্রথম পদক্ষেপ"। মাও সেতুং হয়ে গেলেন কলকাতার নকশাল বিপ্লবীদের ভগবান। সে সময় মাওসেতুংয়ের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের কমিউনিস্টদের হুংকারে কলকাতার আকাশ-বাতাস কাঁপতে লাগলো "চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, বাংলা হবে ভিয়েতনাম, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস ইত্যাদি স্লোগানে"। শ্রেণীস্বার্থ সংগ্রামের কথা শুনিয়ে, বন্দুকের নল দিয়ে রাজত্ব শুরু করলো। এরই নাম কি গণতন্ত্র? বাংলার এক উজ্জ্বল প্রজন্ম ব্যক্তিহত্যার ভ্রান্ত রাজনীতিতে এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। বহু মানুষকে সে সময় খুন হতে হয়েছিল নকশালদের হাতে। বাংলার বুকে নকশালপন্থীদের বীভৎস খুনের রাজনীতিতে এক চরম নিদর্শন রেখে গেছে। নকশালদের হাতে একে একে গণতন্ত্রের খুন হয়েছে, আর সেই সাথেই তারা হাত রাঙিয়ে ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম বলে চেঁচিয়েছে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বুকে বহু ইতিহাস তৈরি হয়েছে। এই সময়টা ছিল, গণতন্ত্রের হত্যাকারী নকশাল যুগের অবসান। এরপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৭ সালে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন বাংলা ও বিদেশিদের কমিউনিস্ট সমর্থিত জ্যোতি বসু। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বাংলার জনগণ ভেবেছিলেন, হয়তো সুদিন ফিরবে, চাষীরা তাদের যোগ্য সম্মান ফিরে পাবে, সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণের সন্তানরা ভালো স্কুলে পড়াশোনা করবে, গরিব অথচ যোগ্য শিক্ষিতরাই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পাবে, উচ্চশিক্ষিতরা নিজস্ব যোগ্যতা অনুযায়ী কর্ম পাবে। বাংলার মা-বোনেরা তাদের হারানো সম্ভ্রম ফিরে পাবে। সুস্থ, সুশীল চিন্তাধারার মানুষরা শান্তি ফিরে পাবে। কিন্তু এসবই ধ্যানধারণা কমিউনিস্টের চিন্তাধারায় ছিল না। বাংলাদেশ সাধারণ জনগণের কাছে শান্তি ও সুরক্ষার মানে দিবাস্বপ্ন হয়ে গেল। বাংলায় পাকাপাকিভাবে জায়গা দখলের পর তারা শুরু করলেন জবর দখলের লড়াই। ভিয়েতনামে নয় এই পশ্চিমবাংলা হয়ে উঠলো বন্দুকের নলই শেষ কথা। অসহায় মানুষদের জমি কেরে নিতে শুরু করলো। বিরোধী ও প্রতিবাদীরা খুন হতে লাগলো। শান্তিপ্রিয় পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ধীরে ধীরে বাকস্বাধীনতা হারিয়ে ফেললো। শুরু হল নারীর ইজ্জত নিয়ে খেলা। নারীরা নিরাপত্তা হীনতায় ভুগতে লাগলো। শুধু তাই নয়, তাঁর আমলে কলকাতায় পুলিশ অফিসার মিহির সেন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে বর্ধমানে সাঁইবাড়ি কংগ্রেস কর্মীকে মেরে তার রক্ত দিয়ে ভাত মাখিয়ে মাকে খাওয়ানোর সেই নৃশংস হত্যাকান্ড, আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী হত্যাকাণ্ড, বাড়ি বাড়িতে সাদা থান পাঠানোর সন্ত্রাস, বেনাচাপড়া কঙ্কাল কান্ড, সুন্দরবনের তিন নম্বর সোনাখালিতে আরএসএস কর্মী হত্যাকন্ড, সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে রক্ত ঝরানো সন্ত্রাস, গণআন্দোলনের মুখ তাপসী মালিক হত্যাকাণ্ড সহ এমন বহু হত্যাকান্ড চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল এই পশ্চিমবাংলায় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছে বহু আগে থেকেই। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড লাল ঝাণ্ডার আমলে আকছার ঘটেই থাকতো। তবে সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, বহু হত্যাকাণ্ডের বিচার আজ সম্পূর্ণ হয়নি। নির্যাতিতার পরিবার সুবিচার পায়নি। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। এমন বীভৎস, নৃশংস গণহত্যার বহু লিখিত, অলিখিত দলিল তৈরি হয়েছে লাল ঝাণ্ডার আমলে। আবার কমিউনিস্টদের চোখের মণি জ্যোতি বসুর আমলে প্রায় ৫৮ হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়েছিল। বহু কারখানার শ্রমিকরা না খেতে পেয়ে ঢোলে পড়েছিল মৃত্যুর কোলে। শিক্ষিত বেকার যুবকদের স্বপ্নগুলো চোখের সামনে কবর দিয়েছিল। যোগ্য শিক্ষিত যুবকরা চাকরি পায়নি। অশিক্ষিত অযোগ্য পার্টির ক্যাডাররা ঝান্ডা ধরে চাকরি পেয়েছিল। এর মাঝে শিক্ষিত বেকাররা পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়ে যায়। যাদের জন্য পশ্চিমবাংলার মানুষ পরিযায়ী শ্রমিকে পরিণত হয়েছে তারাই পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কুমিরের কান্না কাঁদছে। অথচ কারখানার ইউনিয়নগুলোর নেতারা রাতারাতি কোটিপতিতে পরিণত হয়েছিল।
এই অচলাবস্থা থেকে বাংলার সাধারণ জনগণ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কারখানা বন্ধের আন্দোলন করে রাজ্য পরিবর্তন এসেছিল কিন্তু সেখানেও লেখা হয়েছিল রক্তের ইতিহাস। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের কিছু সাধারণ নিরীহ জনগণের রক্তে পা রাঙিয়ে বাংলায় ক্ষমতা দখল করেন তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হল! বর্তমান রাজ্য সরকারের বয়স ১৫ বছর নিশ্চিত। রাজ্যে আজও পর্যন্ত একটা কল কারখানা গড়ে ওঠেনি। তবে বেড়ে চলেছে সন্ত্রাসবাদ। ছোট ছোট শিশুদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে বন্দুক বোমা পিস্তল। এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে সমাজ ব্যবস্থা। কর্মসংস্থান না হলেও জনগণের হাতে দানভিক্ষা তুলে দেওয়া চলছে। এই দশ বছরে পঞ্চায়েত ভোট, পৌরসভা ভোট, বিধানসভা ভোট ও লোকসভা ভোট হয়েছে। তাতেও বহু সাধারণ নিরীহ জনগণের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যু বলতে তাদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। একের পর এক রাজনৈতিককর্মীদের মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা একবারও ভেবে দেখিনি যারা মারা গেল তারাও কিন্তু পশ্চিমবাংলার সন্তান। যা কিছু ঘটেছে সবই আমাদের চোখের সামনে। তবে এই ১০ বছরে সবথেকে জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছে ২০২১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে এবং পরে। বিধানসভা ভোট-পরবর্তী হিংসা এতটাই নির্মমতার পরিচয় দিয়েছিল যে ভারতের বাইরে থেকেও এর প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। বহু ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, বহু কর্মীকে খুন করা হয়েছে। আবার এখনও পর্যন্ত বহু রাজনৈতিক কর্মী বাড়ির বাইরে রাত কাটাচ্ছে। এটাই কি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি? অথচ পশ্চিমবাংলা ভোটের আগে বিহারে ভোট হয়েছিল। সেখানে কোনও রক্ত ঝরেনি। এই ঘটনা কি পশ্চিমবাংলার ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে কলঙ্কিত করেননি? তবে বর্তমান রাজ্য সরকারের লজ্জা-ঘৃণা-ভয় কোনও কিছুই নেই। সিপিআইএম-এর মতো একইরকমভাবে ভোট লুট, বিরোধী হত্যা সবকিছু নকল করেছে। গত রবিবার কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনে রক্তাক্ত চিত্র ধরা পড়েছে পশ্চিমবাংলায়। বর্তমানে রাজ্যের আইকন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মীদের উদ্দেশ্যে কড়া বার্তা দেওয়ার পরেও পৌরসভা ভোট চলাকালীন বহু জায়গায় তৃণমূল সন্ত্রাস চালায়। এই ব্যর্থতার দায় কার? এভাবে ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করেও সিপিআইএম ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি বোধহয় এই সংজ্ঞাটুকু এরা ভুলে গেছে।
এসব দেখেশুনে রাজ্য প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন হাত-পা গুটিয়ে মজা দেখছেন। এরপরে কি এই প্রশ্নটা আসে না যে, নির্বাচন পদ্ধতি বন্ধ হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশন দিনক্ষণ ঘোষণা করে খালাস। সাধারণ জনগণ ও ভোটকর্মীদের নিরাপত্তার দিতে পারে না। আর কতটা রক্তের পথ পার হলে তবে নির্বাচন পদ্ধতি বন্ধ হবে? আর কত মায়ের কোল খালি হলে অশান্ত বাংলা সম্প্রীতি ও শান্তির বাংলাতে ফিরে আসবে, তা দেখার জন্য বাংলা শান্তিপ্রিয় মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছে যুগের পর যুগ।