ADVT

ভোটার কার্ড আধার কার্ড সংযুক্তিকরণ



দীপক সাহা

আপনার পছন্দ হোক বা না-হোক। সমস্ত কাজকর্মকে জলাঞ্জলি দিয়ে নাওয়া-খাওয়াকে শিকেয় তুলে সময় বের করে কোভিড বিধি অমান্য করে রোদ-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আপনাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতেই হবে। তাতে আপনার সারাদিনের রুজিরোজগার চুলোয় যাক। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক বলে কথা। স্বাধীনতার প্ল্যাটিনাম জুবিলি পালন করতে চলেছে আমাদের প্রিয় দেশ। দেশের ও জাতির স্বার্থে না হয় সামান্য কষ্ট করে নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, সুস্থ-অসুস্থ সকলেই লাইনে দাঁড়িয়ে আঙুলের ছাপ আর একবার যাচাই করলেন। আর এই কাজটি করলেই আপনি ভোটের দিন নিশ্চিন্তে নিজের ভোট নিজেই দিতে পারবেন। আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে যেতে পারবে না। ভুয়ো ভোটারা সেদিন অন্য কাজের সন্ধানে ব্যস্ত থাকবে। ভোট কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে তর্জনী উঁচিয়ে কালির দাগ দেখিয়ে সগর্বে বলবেন, আমার ভোট আমি নিজেই দিয়েছি। কী স্বস্তির খবর। জনগণের জন্য নেতানেত্রীদের কতই না চিন্তা! 

ভূমিষ্ট হওয়ার আগেই  মায়ের গর্ভে  অজ্ঞাতনামা অবস্থায় আগামী শিশুর কার্ডের জন্ম। তারপর ভূমিষ্ট হলে বার্থ সাটিফিকেট। এর পর বাচ্চার বয়স বাড়ার সাথে সাথে সার্টিফিকেটের লাইন পড়ে যায়। বাচ্চার আঙুলে ফিংগার প্রিন্ট স্পষ্ট হোক বা না হোক দু'হাতের দশ আঙুল হাতরে হাতরে যেমন করে হোক বাচ্চার আধার কার্ড করতেই হবে। একবার আধার কার্ড হাতে আসলেই আধার কার্ডের সঙ্গে রেশন কার্ড, তারপর আধার কার্ডের সঙ্গে প্যান কার্ড সংযুক্তিকরণের হুড়োহুড়ি। আলমারিরর ভেতর, বিছানার তলায় হরেক রকম কার্ড। সৌজন্যে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। 

একদিকে ইংরেজি বর্ণমালার গুঁতো অন্যদিকে আঞ্চলিক ভাষার স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তাক্ষরের হরেক কিসিমের গোলকধাঁধায় কার্ডে বানানের ভুলভ্রান্তির ছড়াছড়ি। সংশোধন আর সংযুক্তিকরণ এই দুয়ের গ্যাঁড়াকলে অতিষ্ট আমজনতা। বিল ও আইনের যাঁতাকলে নাকানিচোবানি খাচ্ছেন জনগণ। এদিকে জনগণকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পেরে সেবাইত নেতা-মন্ত্রীরা গদগদ।  

আধারের সঙ্গে প্যান কার্ড যুক্ত করার কথা সকলের জানা। এবার আধার কার্ডের সঙ্গে দেশের মানুষের ভোটার কার্ড সংযুক্তিকরণের পথেও হাঁটল কেন্দ্র। সোমবার আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযুক্তিকরণ নিয়ে বিল লোকসভায় পাশ হয়ে গিয়েছে। বিল রাজ্য সভায় পাশ হলে বিলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর হলেই বিল আইনে পরিণত হবে। যে পথে কেন্দ্র এগোচ্ছে তাতে এবার আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড যুক্ত করতে হবে অচিরেই। এজন্য দেশবাসীকে আবার এক ঝক্কিঝামেলার মুখোমুখি হতে হবে।  

আধারের সঙ্গে ভোটারের সংযুক্তি করণ করা গেলে মিটে যাবে ভুয়ো ভাটারের সমস্যা। এমনই দাবি করেছেন দেশের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এইচ এস ব্রাহামা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের ১৬ তম দিনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু পেশ করেছেন নির্বাচনী সংশোধনী বিল। তাতে ভোটার-আধার সংযুক্তিকরণের কথা বলা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন এই লিঙ্ক হলেই অনায়াসে ধরে ফেলা যাবে ভুয়ো ভোটারদের। কাজেই সরকারের পক্ষে এবং গণতন্ত্রের পক্ষেও এটা ভীষণ ভাবে জরুরি বলে মনে করছেন তিনি। 


আধারের সঙ্গে ভোটারের লিঙ্ক করাতে তৎপর মোদী সরকার। ২০২৪-র লোকসভা ভোটের আগেই সেটা করে ফেলতে চাইছেন তাঁরা। বিলটির নাম দেওয়া হয়েছে নির্বাচন সংশোধনী বিল। বিলে আধার-কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযুক্তিকরণের কথা বলা হয়েছে ঠিকই। সেই সঙ্গে যদি কারোর এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হয় তাহলে তাঁর নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে না বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই বিলে, ১৯৫০-র জন প্রতিনিধিত্ব আইন ও ১৯৫১-র জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার সুযোগ বৃদ্ধি করার কথা বলা হয়েছে। এই নিয়ে প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বলেছেন ভারতের মত বিশাল জনসংখ্যার দেশে ভুয়ো ভোটারের সমস্যা প্রবল। তিনি জানিয়েছেন এক জন ব্যক্তির নাম একাধিক জায়গায় ভোটার তালিকায় থাকতে দেখা যায়। সেই সমস্যা মিটে যাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেই। তিনি জানিয়েছেন এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় আরেকটি সুবিধা হবে, কেউ যদি এক শহর থেকে অন্য শহরে যায় তাহলে তাঁর ভোটার আইকার্ডের সঙ্গে আধার কার্ডের সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়া যেন সহজে বদল করা যায়। অর্থাৎ ঠিকানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে আধার কার্ডেও যেন পরিবর্তন ঘটানো যায়। এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়ে অনায়াসেই ভোট দান করতে পারবেন ভোটাররা। তারজন্য একাধিক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে তাঁদের পড়তে হবে না।

প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনকমিশনার দাবি করেছেন আধারের তথ্য গোপন রাখার প্রক্রিয়া অনেক দিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এই সংযুক্তকরণ হলে সেই সব তথ্য গোপন রাখার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যাবে। তাতে বড় কোনও সমস্যায় নাগরিকদের পড়তে হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। আধার প্রধানও এই বিলের সমর্থন জানিয়েছেন। 

বিরোধীপক্ষের দাবি আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার আইডি কার্ড লিঙ্ক করা হলে অনেক ক্ষেত্রে নাগরিকদের তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। আধার কার্ডের সঙ্গে ভোটার কার্ড যুক্ত করার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবশ্য আওয়াজ তুলেছে বিভিন্ন মহল। তাদের দাবি, আধার কার্ড হল কোনও ভারতবাসীর ঠিকানার প্রমাণ এবং বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার নম্বর। অন্যদিকে ভোটার কার্ড সরাসরি একজন ব্যক্তির ভারতীয় নাগরিক হওয়ার প্রমাণ। এই দুটি একসঙ্গে যুক্ত করার প্রশ্নই উঠছে না। দুটি দু'টি ভিন্ন কারণে ব্যবহার হয়। এটা আধার ক্ষেত্রের বাইরে যাওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। আরও দাবি করেছেন, আধার তথ্য ফাঁস হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ডার্ক ওয়েবে ৫০ লক্ষ আধার কার্ডের বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। আধার নম্বরে ঠিকানা ছাড়াও কোনও ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ্যে এসে পড়বে যদি তা ফাঁস হয়। আধার কার্ড এখনও পদ্ধতিগতভাবে সম্পূর্ণ নির্ভুল এমনটাও নয় বলেই দাবি করেছেন অনেকে। প্রসঙ্গত এই বিল পাশ হলে আধারের সঙ্গে যুক্ত করা হবে ইলেকটোরাল রোলকে। 

এই বিলের মাধ্যমে ১৯৫০-র জন প্রতিনিধিত্ব আইন ও ১৯৫১-র জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে পরিবর্তন করা হবে। নির্বাচনী সংস্কারের ক্ষেত্রে এই বিলকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। অর্থাৎ ভোটার কার্ড বাধ্যতামূলক নয় ভোটদানের সময় আধার হলেও হবে, বিলের মাধ্যমে এই আইনই বাস্তবায়িত করতে চলেছে মোদী সরকার। তবে আপাতত, এই সংযুক্তিকরণকে ঐচ্ছিক বলেই পেশ করা হচ্ছে। 

বর্ণময় এ-দেশে বিচিত্র লাইনের ছড়াছড়ি। ডেলিভারি রুম থেকে শ্মশান বা কবরস্থান– সর্বত্র লাইন। লাইন সোজা না বাঁকা সেই প্রশ্ন না করে আবার রেডি হোন, নতুন লাইনে দাঁড়ানোর জন্য। হ্যাঁ, সঙ্গে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড নিতে ভুলবেন না। জানেনই তো কর্তা ইচ্ছা কর্ম।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(02)

আলোচনা করুন, আলোচনায় থাকুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার আলোচনা তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !