Select language to read news in your own language


Like SatSakal Facebook Page to stay updated.

২০ জুন পালন করা হোক বাংলা রাজ্য দিবস 


বটুকৃষ্ণ হালদার

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে দেশভাগ হয়েছিল।এই স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল ভিত্তি স্থান ছিল পশ্চিম বাংলা।আর হাজার হাজার বাঙালি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। দেশ একদিন স্বাধীন হবে। ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য, সেকথা বোধহয় বলার দরকার নেই। যারা স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল কান্ডারী তারাই এ ভারতবর্ষে বর্তমানে অবাঞ্ছিত অবহেলিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। তবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যার ধর্ম নির্বিশেষে সবাই মিলে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর পুরস্কার স্বরূপ মুসলমান না পায় নিজেদের হোমল্যান্ড পাকিস্তান। যে বাঙালি দেশ স্বাধীনতা থেকে শুরু করে নোবেল, অস্কার সর্বক্ষেত্রে উচ্চতার শিখরে ছিল, সেই বাঙ্গালীদের জন্য নিজস্ব হোমল্যান্ড পেতে অনেকটাই বেগ পেতে হয়েছিল। তবে যদি বাংলার অন্যতম বীর সন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় না এগিয়ে আসতেন তাহলে পশ্চিমবাংলা পাকিস্তানের অধীনে চলে যেত।ভারতকে ভেঙে তৈরি হয়েছিল ২ দেশের একদিকে ভারতবর্ষ, আর অন্যদিকে পাকিস্তান।এই সময়ই জন্ম হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ নামে এক অঙ্গ রাজ্যের জন্ম হয়েছিল।

মার্চ, ১৯৪৭। বিধিরেখা স্পষ্ট। দেশভাগ আসন্ন।কিন্তু প্রশ্ন এই যে, বাঙ্গালী হিন্দুর কী হবে? মুসলিম লীগ দাবী তুলেছে, গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে চাই। সেই দাবি মেনে গোটা বাংলা পাকিস্তানে তুলে দিল বাঙালি হিন্দুর ভবিষ্যৎ কী হবে? ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া? কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং তারপরে নোয়াখালি গণহত্যায় বাঙালি হিন্দু নিধন যজ্ঞ ততদিনে হয়ে গিয়েছে, লোকের মুখে মুখে প্রবচন চালু হয়ে গেছে ," সোহরাওয়ার্দীর নরক"।কী হবে তাহলে?

উত্তর দিতে, বাঙালি হিন্দুকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন একজন। ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।তিনি ঘোষণা করলেন, যে কোনও জাতির মতোই বাঙালি হিন্দুরও আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ অধিকার আছে। মুসলিম লিগ যেমন আজ পাকিস্তান চায়, বাঙালি হিন্দুও নিজেদের হোমল্যান্ড চায়। কিন্তু এই দাবির বৈধতা কোথায়? শ্যামাপ্রসাদের দাবি যে বাঙালি হিন্দুর দাবী, তার প্রমাণ কোথায়?

শ্যামাপ্রসাদের হাত শক্ত করতে, জাতির প্রয়োজনে, এই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে এগিয়ে এলেন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা, সেইসঙ্গে এগিয়ে এলো অমৃতবাজার পত্রিকা। ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া অমৃতবাজার পত্রিকা।দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সংবাদপত্র যদি নিজের ভূমিকা পালন না করে, তাহলে সংবাদপত্রের প্রাসঙ্গিকতা কী? এমনটাই মনে করতেন তৎকালীন অমৃতবাজার পত্রিকার কর্ণধারগণ।২৩ শে মার্চ, ১৯৪৭। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সেই ঐতিহাসিক সমীক্ষার কথা। একটি মাত্র প্রশ্ন, পাঠকরা উত্তর দেবেন, "হ্যাঁ" অথবা "না"!

প্রশ্নটি কী?

- আপনি কি বাঙ্গালার হিন্দুদের জন্য পৃথক হোমল্যান্ড চান?

প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল, ৭ ই এপ্রিল, ১৯৪৭-এর মধ্যে পাঠকদের উত্তর পাঠাতে হবে। কিন্তু পাঠকদের বিপুল অর্জিত সেই সময়সীমা বর্ধিত করা হলো, ১৫ ই এপ্রিল, ১৯৪৭ অবধি।

উত্তরগুলির স্ক্রুটিনি করার দায়িত্ব দেওয়া হলো তৎকালীন বিখ্যাত চাটার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট কোম্পানি, গুপ্ত অ্যান্ড মিত্র মেসার্সকে। সেই সঙ্গে স্বেচ্ছায় স্ক্রুটিনি করার দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এলেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন বসু।পাশাপাশি চললো আরেকটি প্রক্রিয়া। শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে তারকেশ্বরে বসলো বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু মহাসভার অধিবেশন। গোটা বাঙ্গালা থেকে ৪০০ জন প্রতিনিধি তাতে উপস্থিত হলেন এবং ৫০ হাজার মানুষের জনসমাগম প্রত্যক্ষ করলো সেই অধিবেশন। সভাপতি হিসাবে ভাষণে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বললেন,

"বাঙালি হিন্দুর মরণ-বাঁচনের প্রশ্ন"। 

শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন জানাতে বক্তব্য রাখলেন সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, সমর্থন করলেন মেঘনাদ সাহা, যদুনাথ সরকার প্রমুখ বুদ্ধিজীবিগণ। বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ড চাই, সনৎ কুমার রায়চৌধুরী এবং সূর্য কুমার বসুর পেশ করা প্রস্তাব বিপুল সমর্থন পাশ হয়ে গেলো। ১০,০০০ স্বেচ্ছাসেবকের বাহিনী প্রস্তুত হলো।

চুপ রইলো না বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসও। ৪ ঠা এপ্রিল, ১৯৪৭-এ বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেসের একটি মিটিং আহ্বান করা হলো, যাতে আমন্ত্রণ জানানো হলো স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদকে মুখোপাধ্যায়কে। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ডক্টর বিধান চন্দ্র রায়, ক্ষিতীশ চন্দ্র নিয়োগী, নলিনী রঞ্জন সরকার, প্রমথনাথ ব্যানার্জি, মাখনলাল সেন, অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ। একই মর্মে 'বাঙ্গালী হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ড চাই" -- এই প্রস্তাব পাশ হয়ে গেলো।

জাতির স্বার্থে হাত মেলালো বঙ্গীয় হিন্দু মহাসভা এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস। এই প্রস্তাবের প্রচারে সর্বমোট ৭৬ টি সভা অনুষ্ঠিত হলো, যার মধ্যে ৫৯ টি কংগ্রেসের উদ্যোগে, ১২ টি হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে এবং ৫ টি যৌথভাবে।

কিন্তু একই সঙ্গে সবার চোখ ছিল অমৃতবাজার পত্রিকার সমীক্ষার দিকে। কী হতে পারে ফলাফল?

পত্রিকার অফিস উত্তরের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছিল। শুধু কী উত্তর, সেই সঙ্গে নিজেদের মতের সমর্থনে অসংখ্য চিঠি।

যুক্ত বঙ্গের প্রস্তাবে সায় দেওয়া এবং শেয়ালের কাছে কুমিরছানা জমা রাখা যে একই জিনিস -- বাঙালি হিন্দু তা সেদিন ভালোই বুঝেছিল।পরের ঘটনাগুলি ঘটলো খুব দ্রুত।২২ শে এপ্রিল দিল্লির পাবলিক র‍্যালিতে শ্যামাপ্রসাদ ব্যাঘ্রগর্জনে বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ডের দাবী জানালেন জনসমক্ষে এবং ঘোষণা করলেন, গোটা বাংলাকে পাকিস্তানে পাঠানোর চক্রান্তের প্রতিবাদ স্বরূপ ২৩ শে এপ্রিল বাংলা বনধ পালন করা হবে।

এদিকে অমৃতবাজার পত্রিকা ঘোষণা করলো, ২৩ শে এপ্রিলই তারা সমীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করবে। গোটা বাংলা সাগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো সেই দিনের।

২৩ এপ্রিল পত্রিকায় সমীক্ষায় ফলাফল প্রকাশিত হতেই উল্লাসে ফেটে পড়লো বাঙালি হিন্দু। নিশ্চিন্ত হলেন শ্যামাপ্রসাদ। বাঙালি হিন্দুর পৃথক হোমল্যান্ডের দাবির সমর্থনে বাঙালি তার রায় জানিয়ে দিলো।

পাঁচ লক্ষ কুড়ি হাজারেরও বেশি বাঙালি, বাঙালি হিন্দুর হোমল্যান্ড গড়ার প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন। তিন হাজার জন বিপক্ষে ভোট দিলেন। ছয় হাজার ভোটার স্লিপ টেকনিক্যাল ভুলের কারণে বাতিল করা হলো।মোট ভোটারদের মধ্যে : অ-মুসলিম ৯৯.৬ শতাংশ,আর মুসলিম:_০.৪শতাংশ

যা প্ৰমাণ করে বাঙালি হিন্দু এবং অমুসলিম ভোটাররা প্রায় সবাই এই প্রস্তাবের পক্ষে ছিলেন।ভোটারদের মধ্যে পুরুষ:_৯৩.৬ শতাংশ,মহিলা:_৬.৪ শতাংশসমীক্ষাকে সার্টিফায়েড করলো গুপ্ত অ্যান্ড মিত্র চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট কোম্পানি। তৎকালীন কলকাতার মিশন রো এক্সটেনশন, উইন্ডসর হাউসে ছিল এদের অফিস। তাঁরা লিখলেন,

ইতিহাস বলে, ২৩ শে এপ্রিল, ১৯৪৭, শ্যামাপ্রসাদের আহ্বানে সেই ঐতিহাসিক বনধ সম্পূর্ণ সফল হয়েছিল। একমাত্র অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ব্যতিরেকে সব দল একে সমর্থন করেছিল। এমনকি শ্যামাপ্রসাদের আহ্বানে এবং উপস্থিততিতে কলকাতার ট্রাম ডিপোর শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীরাও সিটুর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে বনধ পালন করেছিলেন।

১৪ মে, ১৯৪৭ আরেকটি সাপ্লিমেন্টারি ফলাফল প্রকাশ করেছিল অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৫ এপ্রিলের পরে প্রাপ্ত উত্তরগুলিকে গণ্য করে। সেখানে ৭০,৬১৮টি ভোটের মধ্যে ৭০,০৫০টি ভোট অর্থাৎ ৯৮.৭৭% ভোট পড়েছিল "হ্যাঁ"- র পক্ষে, ২৯১টি ভোট অর্থাৎ ০.৪১% ভোট পড়েছিল "না" এর পক্ষে। ৫৮১টি ভোট টেকনিক্যাল কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। হিন্দু ভোটার ৯৯.৮% এবং মুসলিম ভোটার ০.২%।

শেষ বাক্যে বিদ্রুপ করেছিল পত্রিকা, "It is noteworthy that all Muslims polled in favour of partition, but not in favour of partition of Bengal.

আশ্চর্যজনকভাবে ২০ শে জুন বঙ্গীয় বিধানসভায় যখন বিপুল সংখ্যাধিক্যে পশ্চিমবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়েছিল,যে ২১ জনের ভোট প্রস্তাবের বিপক্ষে পড়েছিল, তারা সবাই মুসলিম এবং বাঙ্গালা ভাগের বিপক্ষে থেকে শ্যামাপ্রসাদের বিরোধিতা করা, কমিউনিস্ট পার্টির দু'জন বিধায়ক জ্যোতি বসু ও রতনলাল ব্রহ্মচারী পশ্চিমবঙ্গ গঠনের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলেন। কারণ, "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা" নীতিটি তারা ভালোভাবেই জানতেন!ইতিহাস এভাবেই বিশ্বাসঘাতক এবং সুবিধাবাদীদের চিনিয়ে দেয়।তবে হিন্দুদের রক্ত দিয়ে করা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত।উভয় দেশে হিন্দু প্রায় শূন্য হওয়ার পথে। আর হিন্দুদের হোমল্যান্ড বলে যে রাজ্যটি আত্মপ্রকাশ করে যে রাজ্য টি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এর হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সেই পশ্চিমবাংলায় হিন্দুদের অস্তিত্ব টিকিয়ে থাকার লড়াই শুরু হয়েছে।হিন্দুরা নিজেদের রাজ্যে যেমন উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়েছে, ঠিক তেমনি তারা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদান ভুলতে বসেছে। 

ads banner