ADVT

ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক মহাত্মা গান্ধী



পাভেল আমান 

পৃথিবীতে যুগে যুগে কিছু মানুষ আসেন যাদের নেতৃত্ব দর্শন পাল্টে দেয় গোটা দুনিয়াকে। যারা অন্ধকারে হাজির হন আলোর মশাল হাতে। যারা নিজের জীবনের সবটুকু দিয়ে রচনা করে যান মানবতার বাণী। সেরকমই একজন ব্যক্তিত্ব হলেন মহাত্মা গান্ধী। শান্তি ও অহিংসার পক্ষে দাঁড়িয়ে পৃথিবীতে তিনি স্থাপন করে গেছেন এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত। মহাত্মা' – এই সমাসবদ্ধ শব্দটিকে যদি ভাঙা যায় তবে তার অর্থ হয় 'মহান আত্মা যাঁর'৷ গোটা বিশ্বের কাছে এই নামেই যে মানুষটির পরিচয়, তাঁর জীবনব্রত ছিল মানুষের আত্মিক উন্নতি৷ সে এক দুঃসময়ের দিনকাল, যখন তিনি জন্মেছেন৷ পরাধীন দেশ, পরাধীন জাতি অন্য কোনরকম চিন্তার অবকাশ পায় না সে সময়৷ ১৮৯১ সালে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাঠ সম্পন্ন করে দেশে ফিরলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী৷ ১৮৯৩ সালে এক বছরের চুক্তিতে গেলেন আরও এক ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় ওকালতি করতে৷ সেখানে গিয়ে তিনি বুঝলেন চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনে পিছপাও নয় ব্রিটিশ শাসকরা৷ শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো বলে ভারতীয়রা চরম লাঞ্ছনা আর অসাম্যের শিকার সেখানেও৷ যেমনটি ছিল পরাধীন ভারতবর্ষেরও ছবিটা সেদিন৷ দীর্ঘ একুশ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় থেকে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই চালিয়ে গেলেন তিনি৷দেশে ফিরলেন ১৯১৫ সালে৷ তার পরের পনেরোটা বছর সত্য আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় শুরু হল তাঁর জীবনের আরও একটি সংগ্রামময় অধ্যায়৷ এই পনেরো বছরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন ছোটখাটো চেহারার স্বল্পভাষী মানুষটি৷ তাঁর নেতৃত্বে অথবা তাঁরই দিকনির্দেশনায় একের পর এক আন্দোলন দেখেছে ভারতবাসী৷ সত্যের প্রতি আগ্রহ থেকেই তাঁর 'সত্যাগ্রহ' আন্দোলন আসমুদ্র হিমাচলের মানুষকে এক অবস্থানে নিয়ে এসেছে৷ ধীরে ধীরে সকলের কাছে তিনিই হয়ে উঠেছেন 'বাপু' বা 'বাপুজি'৷ এই 'বাপু' শব্দটির অর্থ পিতা৷ সেই অর্থে সমস্ত জাতি তাঁকেই পিতার সম্মান দিয়েছে৷ পালন করতে চেয়েছে তাঁরই নির্দেশ৷ অনুকরণ করেছে তাঁর সরল সাদাসিধা জীবনযাপন৷ তাঁর স্বপাক আহার কিংবা নিজেই চরকায় সুতো কেটে তাই দিয়ে তৈরি করা খদ্দরের পোশাক পরা শীর্ণ খর্ব অথচ আত্মবিশ্বাসে গরিমাময় গান্ধীজির মূর্তি ক্রমশ প্রতিভাত হয়েছে৷ যেন হয়ে উঠেছে ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক৷

 
কিন্তু ন্যায় ও সত্যের জন্য জেল খাটাকে কোনরকম নীচু চোখে দেখতেন না তিনি৷ গান্ধীজির যুক্তি ছিল, 'আমি নিজে যদি জানি আমি যে কাজ করছি তা সঠিক, তার সঙ্গে রয়েছে আমার নিজের আত্মার সমর্থন, তবে এই কারাবন্দী হওয়া আমার পক্ষে সম্মানের৷'মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী । বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত জননেতা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কান্ডারি। জাতির জনক। যিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। যার জীবনই তাঁর বার্তা। সার্ধ শতবর্ষ পেরিয়েও যার প্রভাব জনমানসে অমলিন।গান্ধীজি একজন পথ প্রদর্শক ছিলেন এবং তাঁর পথ অনেক লোকের জীবনের পথ হয়েছে। তাঁর সমস্ত কার্যকাল ধরে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন স্বাধীন ভারতের সম্ভাবনার উজ্জ্বল ভবিষ্য। তিনি একজন রাষ্ট্রবান্ধব নেতা ছিলেন এবং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নানারকম সমস্যার সমাধানে দিয়ে গড়ে গান্ধীজির মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীন ভারতের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পুরণ করা। তিনি পরিশ্রমী, নির্ভীক এবং উন্নয়নশীল একজন নেতা ছিলেন। তাঁর সমস্ত কার্যকাল ধরে তিনি একজন সমগ্র ভারতের জনপ্রিয় নেতা হয়েছিলেন এবং তাঁর কার্যকালে পূর্ণতা সম্পন্ন হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রক্রিয়া।অহিংসা এবং শান্তির দূত মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ভারতে জাতির জনক বলে সমাদৃত। সারা বিশ্ব তাঁকে জানে মহাত্মা বলে। রাষ্ট্রসংঘ বিশ্বে অহিংসা এবং শান্তির বার্তা প্রচারে তাঁর জন্মদিন ২রা অক্টোবর আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস হিসেবে উদযাপন করে। তিনি সত্য এবং অহিংসার ভিত্তিতে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গান্ধী বলেছিলেন মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি হল অহিংসা। ধ্বংসের কাজে নিযুক্ত সব চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের চেয়েও  এটি অধিক শক্তিমান। সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অন্যতম প্রেরণার উৎস ছিলেন গান্ধীজি। পৃথিবীর যেখানেই নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের কান্না শুনেছেন সেখানেই ছুটে গিয়েছেন তিনি। বিশ্বের অনেক নেতা, দেশ এবং সম্প্রদায় মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক নিপীড়িত সমাজ সাফল্যের সঙ্গে গান্ধীবাদকে ব্যবহার করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজা মার্টিন লুথার, ভীয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন এবং মিয়ানমারের আং সান সু চি মহাত্মা গান্ধীর অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আমাদের সামাজিক পরিসরের বুননে মহাত্মা গান্ধীর উপস্থিতি এখনও অমোঘ, বিশেষত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রশ্নে তিনি এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। ধর্মনিরপেক্ষতা যা বলে, তা সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর নিজের ধর্ম মেনে চলার সম্পূর্ণ অধিকারের কথা। এটাই ছিল গান্ধীর দর্শন। তার মতে, প্রকৃত ধার্মিক শুধু ভিন্ন ধর্মের প্রতি সম্পূর্ণ সহনশীল নন, সেই ধর্মের মধ্যে যা উত্তম, তা গ্রহণে সদাপ্রস্তুত। অন্য দিকে, সম্পূর্ণ অহিংসার দর্শন তাকে শিখিয়েছিল সব মানুষের প্রতি সমভাবাপন্ন হতে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, তার স্বপ্নের ভারতবর্ষে কোনও একটি ধর্মের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে না— সেই ভারতে প্রতিটি ধর্ম সম-অধিকারে একে অপরের সঙ্গে সহাবস্থান করবে।মহাত্মা গান্ধী মানেই চশমা বা খাদির ক্যালেন্ডারে চরকাশোভিত একজন ব্যক্তি নন। মানুষটি ধর্ম বিষয়ে এবং পরধর্ম বিষয়ে, ধর্মীয় পরিচয়ের গুরুত্ব বিষয়ে এবং হিন্দু-মুসলমান ঐক্য বিষয়ে যা যা বলে গেছেন বা লিখে গেছেন সেগুলোর প্রতিটি অক্ষর সাম্প্রদায়িকতা-ভিত্তিক এখনকার রাজনীতির বিপ্রতীপ। আজকে চারিদিকে যখন বিদ্বেষ বিভাজন সাম্প্রদায়িকতার বীভৎসতা হারিয়ে গেছে মানুষে মানুষে বিশ্বাস সহিষ্ণুতা শান্তি ঠিক সেই মুহূর্তে মহাত্মা গান্ধীর সহজ সরল যাপিত জীবন পথ চলা অহিংসা ও সত্যবাদিতা আমাদের সংকটের
আধার থেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলে । এই মহাপুরুষের জন্মদিনে আমরা প্রত্যেকেই তাকে দিনযাপনে স্মরণ করার অঙ্গীকার হয় করি  মনুষ্যত্বের জাগরণে ভালো মানুষ হয়ে উঠতে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(CLOSE) #days=(02)

আলোচনা করুন, আলোচনায় থাকুন। এখানে টাচ করে দেখে নিন, কীভাবে লেখা মেল করবেন। আপনার আলোচনা তুলে ধরুন পাঠকের সামনে।
Accept !