ধ্রুব চৌধুরী
বর্তমান কালে শরৎকালীন দুর্গাপুজোই বাঙালির প্রধান উৎসব। প্রাচীন শাস্ত্র আমাদের জানাচ্ছে যে, দেবী দুর্গা রাজন্যবর্গের দেবী, তাই তিনি রজগুণসম্পন্না, আর যুদ্ধজয়লাভের প্রতীক। আগেকার দিনে প্রভাব প্রতাপশালী রাজা-জমিদারাই কেবল মাত্র দুর্গাপুজো করার সামর্থ্য রাখতেন। বাংলার হাওড়া-হুগলির মধ্যে যে সব পুরোনো প্রতাপশালী জমিদার বংশের দুর্গাপুজোর ইতিহাস খুঁজে বার করা যায় তাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল হাওড়ার আন্দুলের দত্তচৌধুরী, তথা আন্দুলের চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো।
এঁদের পারিবারিক ইতিহাস যেমন ভাবে নথিভুক্ত করা রয়েছে সেই মতে এঁদের কৌলিক পরিচয়ে দক্ষিণ-রাঢীয় কায়স্থ সমাজভুক্ত কনৌজ-উদ্ভব ভরদ্বাজ গোত্রীয় পুরুষোত্তম দত্ত বংশজাত 'বালির দত্ত' পরিবারের দ্বাদশ পুরুষ দেবদাস (তেকড়ি) দত্ত চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে বাবা মুরারি দত্তবিশ্বাসের মুজঃফরপুর পরগনার বিস্তীর্ণ এস্টস্টের উত্তরাধিকারী হয়ে সরস্বতী নদীর পশ্চিম-উপকূলে মৌজা আন্দুল-মহিয়াড়ী অঞ্চলে বাজরা যোগে এসে উপস্থিত হলেন, ক্রমে সেই জনপদে তিনি স্বশাসিত জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠা পেলেন। মোট ২৫২ বিঘা ভদ্রাসন জমির ওপর নির্ম্মাণ হয়েছিল জমিদার তেকড়ীর প্রাসাদ। একেতো তাঁর সুবিস্তীর্ণ এস্টেট (পরগনা) মালিকানা আর দ্বিতীয়ত সেখানে জমিদার রূপে তাঁর প্রভূত উন্নত অবস্থা যা বিচার করে তৎকালীন তাঁর সমসাময়িক স্বাধীন বাংলার সুলতান রাজার দ্বিতীয় সুলতান সিকান্দর শাহ তাঁকে সে পরগনার 'চৌধুরী' উপাধিতে প্রধান রাজস্ব আদায়কারী পদে নিযুক্ত করেন আর এই ভাবে তেকড়ি দত্ত চতুরঙ্গদলপতী হয়ে ছিলেন। এর পর থেকে আন্দুলের দত্ত বংশ 'দত্তচৌধুরী' নামে পরিচয় পেয়ে থাকে।
মধ্যযুগে আজকের হাওড়া ও হুগলী জেলা নিয়ে ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের সুবাহ বাংলার সপ্তগ্রাম সরকার। সেই সরকারের অন্তর্বর্ত্তী তেপ্পান্নটা পরগনার মধ্যে একটা ছিল মুজঃফরপুর পরগনা (সুলতান রাজ থেকে) আর তেকড়ি দত্ত থেকে সেই পরগনার ভারপ্রাপ্ত ৬-তম 'চৌধুরী' রামশরণ দত্ত (ইং ১৫৪৮-১৬০৬) এই বংশে প্রথম দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন বলে এই পরিবারের কাছে রাখা এঁদের প্রাচীন কুলপঞ্জিকাতে লেখা আছে। এই পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য হেমোৎপল চৌধুরীর লেখা 'Dutta Chaudhuri Ancestry' বই, সুপ্তি বসুর লেখা 'স্মৃতির কথা' ও স্বনামধন্য সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কুলোদ্ভব শুভদীপ রায়চৌধুরীর লেখা 'বনেদি কলকাতার দুর্গোৎসব' বই থেকে এই পুজো শুরু হওয়ার সাল ইং ১৫৬৮-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সেই সময়কার দুর্গামূর্ত্তি থেকে পুজোপদ্ধতি আজ নানান কারণে অনেকটাই বদলে গেছে আন্দুলের এই চৌধুরী বাড়িতে।
ইংরেজ রাজত্বের সূর্য্যদয়ের বহু কাল আগেই এঁরা এঁদের পৈতৃক জমিদারি ও চতুরঙ্গদলপতির পদ থেকে বিরত হয়ে সব সাধারণ চাকুরীজীবি হয়ে পড়েন। কিন্তু আজও এঁরা নামান্তে তাঁদের পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে তাঁদের ব্যবহৃত রাজস্ব–আদায়কারীর কার্যকরী উপাধি 'চৌধুরী' ব্যবহার করে থাকেন। আন্দুলে আজ রামশরণ দত্তচৌধুরী বংশের মোট দু-এক ঘর চৌধুরীদের বাস। অধিকাংশই পড়াশোনা ও কর্ম্মসূত্রে আন্দুল ছেড়ে ভারতবর্ষের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি বিদেশেও। নেই আর সেই চৌধুরী প্রাসাদ, নেই তাঁদের হাতিশালা এবং ঘোড়াশালাও, রয়ে গেছে শুধু মাত্র এই বার্ষিকী শারদীয়া দুর্গাপুজো ও দুর্গাদালান সংলগ্ন দেবোত্তর শিবালয়, যা সমগ্র এই পরিবরের সদস্যদের একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। এঁদের জমিদারি সময়কার দুর্গাপুজোর সেই আড়ম্বর হয়তো এখন আর নেই কিন্তু সমান মর্যাদা ও ভক্তি দিয়ে বংশপরম্পর ৪৫৫ বছর অবিচ্ছিন্ন ভাবে দুর্গাপুজো বজায় রেখেছে চৌধুরী পরিবারের সদ্যসরা।
এই পরিবারে দেবী দুর্গা দক্ষিণ-মুখী হওয়ার কারণে তিনি এখানে দক্ষিণা। পরিবারের এক সদ্যস মিতা বসু (চৌধুরী)-র কাছ থেকে জনতা পারা যায় যে আগে এঁদের উল্টো-রথের দিনে কাঠামো পুজো হত, কিন্তু বর্ত্তমানে তা জন্মাষ্ঠমীর দিনে হয়ে থাকে। এঁদের দেবীমূর্ত্তি যেমনটা লক্ষ্য করা যায় তা হল মৃন্ময়ী অস্থায়ী মূর্ত্তিতে সসিংহ ও সপরিবারে দশভুজা মহিষমর্দিনী ডাকের সাজের সাথে থাকে টানাচৌরি চালচিত্র। দেবী এখানে মৃত্তিকার বেদির উপর পুজিতা। দেবী সরস্বতীর চালিতে আঁকা থাকে দক্ষিণাকালীর চিত্র, দেবী লক্ষীর চালিতে আঁকা থাকে জগদ্ধাত্রীর চিত্র এবং দেবী দুর্গার চালিতে আঁকা থাকে অনন্ত-বিষ্ণুদেবের চিত্র। আরেকটা জিনিষ যেটা বিশেষ লক্ষনীয় এঁদের দুর্গামূর্তিতে সেটা হল এঁদের লক্ষীর চালির উপর জয়া ও সরস্বতীর চালির উপর থাকে বিজয়ার ছোট মূর্ত্তি, কারণ জয়া ও বিজয়া হল দেবী দুর্গার দুই সখী বা সহচরী। আর যেটা লক্ষণীয় সেটা হল দেবী দুর্গার ও লক্ষীর গাত্রবর্ণ কমলা মেশানো তপ্তকাঞ্চন ও শাড়ি লাল, সরস্বতীর শুভ্র বর্ণ ও শাড়ি নীল, কার্ত্তিকের অবয়ব হয় হরিদ্রাভ ও ধুতি সাদা ও তাঁর বাহন অংশত হরিদ্রাভ এবং খয়েরী, গনেশের মুখমণ্ডল শুভ্র ও দেহ হালকা গোলাপি ও ধুতি হলুদ। দুর্গার বাহন মহাসিংহের গায়ের রঙ অংশত হরিদ্রাভ ও খয়েরী ও অসুর-রাজ মহিষাসুরের গায়ের রঙ সবুজ। লক্ষী-ও-সরস্বতী পদ্মের ওপর দণ্ডায়মান। চৌধুরী বাড়ির এক প্রবীণ সদস্য দেবীপ্রসাদ দত্তচৌধুরী জানান যে তিনি তার ছোটবেলায় এই ঠাকুরের মাটির সাজ হতে দেখেছেন। মূর্ত্তি নির্ম্মানের কাজ এঁদের পারিবারিক ঠাকুরদালানেই হয়ে থাকে।
বাড়ির সদস্যদের থেকে জানতে পারা যায় যে এঁদের পুজো হয় বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণ ও গুপ্ত প্রেস মতে। বোধন বসে কৃষ্ণনবমী তিথীতে আর শেষ হয় দুর্গানবমীতে, অর্থাৎ দেবী চণ্ডীর কল্পারম্ভ ও ঘট বসে যায় পুজোর ঠিক বারো দিন আগে। স্থানীয়ভাবে এই বাড়ির ভোগ বিশেষ জনপ্রিয়। পুরীর লম্বা জিবেগজা দেবীর প্রসাদের মধ্যে অন্যতম। সপ্তমী, অষ্টমী এবং মহানবমী – পুজোর এই তিন দিন দেবীর বিশেষ ভোগ হল অন্নভোগ; সপ্তমী ও অষ্টমীতে খিচুড়ি এবং নবমীতে পোলাও, সাথে থাকে পাঁচরকম ভাজা, চাটনি ও চালের পায়েস। পুরনো রীতি মেনে এখনও বাড়ির সদ্যসদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের সময় 'বাবা, রামশরণের কড়াই ধর' বলার রীতি আছে, এটার কারণ যেটা জানতে পারা যায় তা হল এঁদের পূর্বপুরুষ রামশরণের সময়তে পরিবারে যে ক্ষতি হয়ে ছিল তা পূরণ করো। পরিবারের এক বয়স্ক গৃহবধূ কবিতা চৌধুরী জানান যে অষ্টমীর দিন ২১টা কালোপ্রদীপের আরতি এ পরিবারের বিশেষ রীতি। অষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে ১০৮টা প্রদীপ প্রথমে বাড়ির ছেলেরা ও তার পরে উপস্থিত ইচ্ছুকেরা জ্বালিয়ে থাকে। মহানবমীর দিনে ব্রাহ্মণ ও অব্রাহ্মণ জোড়া কুমারীপুজো হয়ে থাকে এই বাড়িতে। সে দিনে এঁদের হোম ও বলিদানও হয়ে থাকে, যথা আঁখ বলি, চালকুমড়ো বলি এবং চালের পিটুলি দিয়ে মানুষাকৃতি তৈরী করে দেয়া হয় 'শত্রু বলি', যার মানে হল পরিবারের শত্রুর বিনাশ হক। এই 'শত্রু' বাড়ির ছেলেরা তৈরী করে। বিজয়া দশমীর সন্ধ্যের সময় বাড়ির বৌরা দেবীকে বরণ ও কনকাঞ্জলি দিয়ে থাকে। চৌধুরী পাড়ার বিভিন্ন বাড়ি থেকে অনেক বৌরাও আসে এই ঠাকুর বরণ করতে। পার্শবর্তী ঝোড়হাট গ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের লোকেরা দেবীকে তাহাদের কাঁধে করে শোভাযাত্রার সঙ্গে নিয়ে দুলেপাড়াতে। ওই শোভাযাত্রায় চৌধুরী বাড়ির মেয়ে ও বৌদের অংশগ্রহণ করার নিয়ম নেই। দুলেপাড়ার দুলেরা একসময়ে এঁদের অনুগত প্রজা ছিল বলে জানা যায়। সেখানে বরণ হওয়ার পর পুনরায় দেবীকে শোভাযাত্রা করে চৌধুরী পাড়ায় নিয়ে এসে পরিবারের দালানের কাছে পুকুরেই প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। আগে সরস্বতী নদীর তীরে পরিবারের নিজেস্ব ঘাট ছিল, সেখানেই প্রতিমা নিরঞ্জনের কাজ সমাপ্ত হত বলে জানান চৌধুরী বাড়ির সদস্য।
একসময় এই দুর্গাপুজো সম্পূর্ণ পরিবারের পৈত্রিক মালিকানা দেবোত্তর সম্পত্তির আয় থেকে নির্বাহিত হয়ে থাকতো। যেহেতু এটা জমিদার বংশের পুজো তাই পাড়ার লোকেদের অংশগ্রহণও বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়, কারণ রামশরণ যখন প্রথম এই পুজো শুরু করে ছিলেন তখন সে অঞ্চলে দুর্গাপুজো বলতে সম্ভবত এই একটাই। প্রজাকুল, দাস-দাসী, এস্টেটের কর্ম্মচারী সহ গোটা গ্রামবাসী আনন্দে মেতে উঠত চৌধুরীদের দুর্গাপুজোর ঢাকের আওয়াজে। সব মিলিয়ে শারদীয়া এই মহাপুজো যেন মহানন্দের উৎসবে পরিণত হত চৌধুরী বাড়ির ঠাকুরদালানে।
x